বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রান্তরে এমন অনেক গাছ আছে যেগুলো আমাদের স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার মধ্যে একটি অত্যন্ত পরিচিত ও উপকারী গাছ হলো সাজনা গাছ। গ্রামীণ বাংলায় একে “সজনে গাছ” বলেও ডাকা হয়। এটি শুধু একটি উদ্ভিদ নয় বরং একটি জীবন্ত ভান্ডার। সাজনা গাছের পাতা, কাণ্ড, ফুল, বীজ এমনকি ছালও আমাদের নানা কাজে লাগে। এর খাদ্যগুণ, ঔষধি ব্যবহার, পরিবেশগত অবদান এবং আর্থিক গুরুত্ব একে একটি অনন্য গাছে পরিণত করেছে। আমাদের দেশে সাজনা গাছ বর্ষাকালে রাস্তার পাশে বা বাড়ির আঙিনায় ফুলে-ফলে ভরে উঠে। এর ডাটার ঝোল বা ভাজি শুধু রুচিকর নয়, পুষ্টিকরও বটে।
আর পড়ুন: দারুচিনি গাছ
বাংলাদেশের জলবায়ু এবং মাটির গঠন সাজনা গাছ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই গাছ প্রায় সারা দেশেই জন্মে, এমনকি খরা বা অনাবৃষ্টি প্রবণ অঞ্চলেও সহজেই টিকে থাকতে পারে। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে সাজনা শুধু একটি সবজি নয়, এটি তাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অংশ। বসন্তকালে যখন সাজনার ফুল ফুটে তখন তা শুধু গাছ নয়, চারপাশকেও শোভিত করে তোলে। আজকাল শহরের ছাদবাগানেও ছোট আকৃতির সাজনা গাছ দেখা যাচ্ছে।
সাজনা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ও শ্রেণীবিভাগ
সাজনা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Moringa oleifera। এটি Moringaceae পরিবারভুক্ত একটি দ্রুত বর্ধনশীল চিরহরিৎ বৃক্ষ। এই গাছের উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে হলেও বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন উষ্ণ ও উপউষ্ণ অঞ্চলে এর চাষ হচ্ছে। Moringa শব্দটি এসেছে তামিল ভাষার ‘মুরুঙ্গাই’ শব্দ থেকে যার অর্থ বাঁকা বা মোচড়ানো। এটি মূলত এর ডাটার গঠনকে বোঝায়।
এই উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী:
-
রাজ্য: Plantae
-
পর্ব: Tracheophyta
-
শ্রেণী: Magnoliopsida
-
বর্গ: Brassicales
-
পরিবার: Moringaceae
-
গণ: Moringa
-
প্রজাতি: Moringa oleifera
Moringa oleifera প্রজাতির পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে, তবে বাংলাদেশে একমাত্র এই প্রজাতিটিই ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং ব্যবহৃত। এর পরিচিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একে “মিরাকল ট্রি” বা “পাওয়ারহাউস প্ল্যান্ট” বলেও অভিহিত করা হয়। কারণ এর সব অংশই ব্যবহারযোগ্য এবং পুষ্টিতে ভরপুর।
সাজনা গাছের নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন A, C, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও আয়রন। এর শিকড়ে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, পাতা ও বীজে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ফলে এটি একটি মেডিসিনাল এবং নিউট্রিশনাল গাছ হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
সাজনা গাছের ইতিহাস ও দেশীয় প্রসার
সাজনা গাছের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। ভারতীয় উপমহাদেশে এর চাষ শুরু হয় প্রাচীনকালেই, যেখানে এটি আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। ভারত, নেপাল এবং বাংলাদেশে এই গাছ বিভিন্ন রোগের প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন ভারতের ঋষিমুনিরা একে “শক্তির গাছ” বলতেন। সে সময়েও এর পাতার রস, ডাটার গুঁড়া এবং মূলের নির্যাস নানা রোগে ব্যবহার হতো।
বাংলাদেশে সাজনা গাছের ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরেই চালু আছে। গ্রামে প্রতি বাড়ির আঙিনায় একটি করে সাজনা গাছ থাকা খুব সাধারণ বিষয়। বিশেষ করে বরিশাল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, পাবনা, রাজশাহী অঞ্চলে এ গাছের চাষ ব্যাপকহারে হয়ে থাকে। বাংলার মাটির সঙ্গে এর এক অপূর্ব যোগসূত্র রয়েছে। মাঘ-ফাল্গুন মাসে এর ফুল ফুটে আর চৈত্র-বৈশাখ মাসে ডাটা সংগ্রহ করা হয়।
বাঙালি রান্নার ঐতিহ্যে সাজনা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ডাল বা আলুভর্তার সাথে ডাটা যোগ করলে যেমন স্বাদ বাড়ে, তেমনি বাড়ে পুষ্টিগুণও। অনেক সময় বিয়ে বা উৎসবের বিশেষ রান্নায় সাজনা ডাটা ব্যবহার করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) এ গাছ নিয়ে গবেষণা শুরু করে এবং এর ফলাফলে আজ কৃষি ও স্বাস্থ্য দুই ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে।
সাজনা গাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য
সাজনা গাছ একটি মাঝারি থেকে লম্বা আকৃতির বৃক্ষ। সাধারণত এর উচ্চতা ৭ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। গাছটি খুব দ্রুত বর্ধনশীল, ভালো পরিচর্যায় ১ বছরের মধ্যেই ফুল ও ফল দিতে সক্ষম হয়। এর শাখা প্রশাখা বেশ নরম এবং ভঙ্গুর। তবে গাছ পরিণত হলে কাণ্ড বেশ শক্ত হয়ে যায়।
পাতা, ফুল ও বীজের ধরন
সাজনা গাছের পাতা যৌগিক এবং পালক আকৃতির। একটি পাতায় গড়ে ২০-২৫টি ছোট পাতার গুচ্ছ থাকে। পাতার রং গাঢ় সবুজ এবং পাতা অত্যন্ত পুষ্টিকর। প্রতিটি পাতা ১ থেকে ৩ সেমি লম্বা হয়।
ফুল সাধারণত হালকা সাদা বা ক্রিম রঙের হয়ে থাকে। এগুলো খুব ছোট আকারের, সুগন্ধি এবং ঝাঁক বেঁধে ফোটে। ফুল বসন্তকালে ফুটে এবং মৌমাছি বা অন্যান্য পরাগ বাহিত পোকামাকড় দ্বারা পরাগায়ন হয়।
বীজগুলো পাতলা বাদামি রঙের এবং এদের চারপাশে পাতলা পাখার মতো গঠন থাকে। এই বীজ থেকেই নতুন গাছ জন্মানো সম্ভব। বীজে থাকা তেল (মরিংগা অয়েল) খুবই উন্নতমানের এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে।
উচ্চতা, ছাল ও ডালপালা
সাজনা গাছের কাণ্ড শক্ত ও মসৃণ। ছালের রং সাধারণত হালকা ধূসর বা বাদামি হয় এবং ছাল খুব সহজেই খসে পড়ে। এই ছাল আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ডালগুলো পাতলা, নমনীয় এবং নিচের দিক থেকে ছড়িয়ে পড়ে। একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ ডাটা দিতে পারে।
সাজনা গাছের প্রাকৃতিক আবহাওয়া ও বাড়বার এলাকা
সাজনা গাছ মূলত গরম ও শুষ্ক পরিবেশে ভালো জন্মায়। এটি একটি শুষ্কমুখী গাছ যা অল্প পানি ও কম পরিচর্যায়ও বেড়ে উঠতে পারে। তবে উন্নত ফলনের জন্য প্রাকৃতিক আলো, উর্বর মাটি ও পরিমিত জল আবশ্যক। ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং হালকা বেলে দোআঁশ মাটি এই গাছের জন্য সর্বোত্তম। অতিরিক্ত বর্ষা বা জলাবদ্ধতা এ গাছের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই এই গাছের চাষ দেখা যায়। বিশেষ করে রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও যশোর অঞ্চলে সাজনা গাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। শহরাঞ্চলেও ছাদবাগান বা ছোট জমিতে এই গাছ লাগানো হয়।
এই গাছের মূল সুবিধা হলো, এটি খরা বা অনাবৃষ্টি সহ্য করতে পারে। তাই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেখানে পানির অভাব রয়েছে, সেখানে এটি একটি বিকল্প সবজি হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে। এর ডাটা বছরে একাধিকবার সংগ্রহ করা সম্ভব। একটি গাছ থেকে গড়ে ২০ থেকে ৩০ কেজি ডাটা পাওয়া যায় এবং বাজারে প্রতি কেজি সাজনা ডাটার দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, মৌসুমি চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। ফুল এবং পাতাও বাজারে বিক্রি হয়, যদিও তার চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম।
সাজনা গাছ কোথায় পাওয়া যায়
বাংলাদেশে সাজনা গাছ প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। এটি এমন একটি গাছ যা প্রাকৃতিকভাবে জন্মে এবং সহজে বংশ বিস্তার করতে পারে। দেশের গ্রামাঞ্চলে রাস্তার পাশে, জমির আইলে, বাড়ির আঙিনায় এমনকি পতিত জমিতেও এই গাছ দেখা যায়। যদিও এই গাছ সাধারণত বীজ থেকে জন্মে, তবে কাণ্ড থেকেও চারা উৎপাদন সম্ভব।
বর্তমানে সাজনা গাছ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের কারণে চাষিদের কাছ থেকে, স্থানীয় নার্সারি, বীজ ও কৃষি উপকরণ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান থেকে এবং অনলাইন কৃষি প্ল্যাটফর্ম থেকেও সাজনা চারা সংগ্রহ করা যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও খুলনাসহ বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা শহরেই কিছু না কিছু কৃষি নার্সারিতে সাজনার চারা বিক্রি হয়।
সাধারণত ১ থেকে ২ ফুট উচ্চতার চারা গাছের দাম পড়ে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। যদি কাণ্ডের কাটিং থেকে তৈরি উন্নত জাতের চারা নেওয়া হয়, তবে তার দাম ৮০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বিভিন্ন উন্নতজাত যেমন BARI Moringa-1 বা বারি সজনে জাতের চারা কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায় এবং সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা সাধারণ সাজনা গাছের তুলনায় বেশি।
যারা শহরে ছাদবাগান করতে চান, তারা টবেও সাজনা গাছ লাগাতে পারেন। টবের গাছ থেকে ফলন তুলনামূলক কম হলেও পাতা এবং কিছুটা ডাটা পাওয়া সম্ভব। এর জন্য বেলে দোআঁশ মাটি ও ভালো পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
আর পড়ুন: ডালিম গাছ
সাজনা গাছের চাষাবাদ
সাজনা গাছের চাষাবাদ তুলনামূলকভাবে সহজ এবং কম খরচে লাভজনক সবজি হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য প্রয়োজন কিছু প্রাথমিক জ্ঞান এবং পরিকল্পিত পরিচর্যা।
মাটি ও জলবায়ুর উপযোগিতা
সাজনা গাছের জন্য হালকা বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। পানি জমে থাকে এমন মাটিতে এই গাছ জন্মাতে পারে না। তাই জলাবদ্ধতা মুক্ত উঁচু জমিতে সাজনা চাষ করা উচিত। যেসব অঞ্চলে খরা প্রবণতা বেশি, সেখানে এই গাছ ভালো ফলন দেয়।
জলবায়ুর দিক দিয়ে বলা যায়, ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই গাছের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। প্রচুর আলো ও উষ্ণ পরিবেশে সাজনা গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং ফুল ও ডাটা দেয়। যদিও এটি বৃষ্টির মৌসুমে দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তবে খুব বেশি বর্ষণ এ গাছের ক্ষতি করতে পারে।
রোপণ পদ্ধতি ও সেচ ব্যবস্থা
সাজনা গাছ চারা অথবা বীজ থেকে লাগানো যায়। তবে কাণ্ড কাটিং থেকে লাগানো চারায় ফলন বেশি হয়। সাধারণত ১.৫ ফুট গভীর গর্ত করে তাতে গোবর সার ও কিছু ছাই মিশিয়ে চারা রোপণ করা হয়। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব রাখতে হয় প্রায় ৬ থেকে ৮ ফুট। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে চাইলে সারি ধরে রোপণ এবং সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
প্রথম ২-৩ মাসে সপ্তাহে একবার সেচ দেওয়া ভালো। বর্ষাকালে সেচের প্রয়োজন পড়ে না, তবে শুষ্ক মৌসুমে ১০-১৫ দিন পরপর সেচ দিলে গাছ সতেজ থাকে এবং ফলন বাড়ে। টবের গাছ হলে সপ্তাহে অন্তত ২ বার পানি দিতে হবে।
সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা
সাজনা গাছ সাধারণত কম সারেই ভালো জন্মে। তবে উন্নত ফলনের জন্য গোবর সার, ভুষি সার, ছাই এবং ইউরিয়া প্রয়োগ করা যেতে পারে। রোপণের সময় প্রতি গর্তে ৫ কেজি গোবর সার ও ২০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম এমওপি ব্যবহার করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
চারা রোপণের পর নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয় এবং গাছের ডালপালা ছাঁটাই করলে সেটি বাড়তে সুবিধা হয়। গাছ ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে প্রথমবার ডাটা দেয় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে আরো বেশি ডাটা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
রোগ-শত্রু নিয়ন্ত্রণ
সাজনা গাছ তুলনামূলকভাবে রোগ প্রতিরোধক্ষম। তবে মাঝে মাঝে শুঁয়োপোকা, পাতাঝরা রোগ এবং ধসা রোগ দেখা যায়। পাতা যদি হলুদ হয়ে ঝরে যায় তবে বুঝতে হবে ছত্রাকজাতীয় আক্রমণ হয়েছে। এ অবস্থায় জৈব ছত্রাকনাশক বা নিম তেল স্প্রে করা যেতে পারে।
কখনো কখনো ডাটায় পোকা ঢুকে যায়, যা ডাটাকে নষ্ট করে। এজন্য প্রাথমিক অবস্থায় ডাটা পর্যবেক্ষণ করে আক্রান্ত অংশ তুলে ফেলা উচিত। রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুমোদিত এবং খাদ্য নিরাপদ উপাদান ব্যবহার করতে হবে।
সাজনা গাছের বাগান শোভা ও ল্যান্ডস্কেপিং এ ব্যবহার
সাজনা গাছ শুধু খাওয়ার উপযোগী নয়, এটি একটি দৃষ্টিনন্দন গাছও বটে। বসন্তকালে যখন ফুল ফোটে তখন এই গাছ এক অপূর্ব সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। ফুলের রং, পাতার গঠন এবং ডাটার ঝুলন্ত অবস্থা গাছটিকে একটি স্বতন্ত্র শোভা দেয়। ফলে অনেকেই এই গাছকে বাগানে শোভামূলক গাছ হিসেবেও ব্যবহার করেন।
পারিবারিক আঙিনা, গ্রামের রাস্তার ধারে, বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ, কিংবা শহরের ছাদবাগানেও এই গাছ লাগানো যায়। যেহেতু এটি দ্রুত বাড়ে এবং বড় আকার ধারণ করে, তাই বাড়ির এক কোনে লাগালে তা ছায়াও দেয় এবং সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করে।
ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন যারা করেন, তাদের জন্য সাজনা একটি বহুমুখী গাছ। এর মাধ্যমে পরিবেশে সবুজত্ব, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং স্থাপত্যিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব। কিছু অভিজাত রেস্টুরেন্ট বা বুটিক রিসোর্টেও সাজনা গাছ শোভা বৃক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে গাছের নিচে বসার জায়গা তৈরি করে অতিথিদের জন্য ছায়া ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা যায়।
সাজনা গাছের ঔষধি ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
সাজনা গাছকে বলা হয় “মিরাকল ট্রি” কারণ এর প্রতিটি অংশে রয়েছে অসাধারণ ঔষধি গুণ। প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসায় এই গাছ ব্যবহার হয়ে আসছে। আধুনিক গবেষণাতেও এটি প্রমাণিত হয়েছে যে সাজনা একটি শক্তিশালী পুষ্টিকর ও রোগপ্রতিরোধী গাছ।
পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A, C, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। একটি গ্লাস সাজনা পাতার রসে প্রায় সমপরিমাণ গাজরের তুলনায় ৪ গুণ বেশি ভিটামিন A থাকে। এর ফলে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়, ত্বক সতেজ থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
সাজনা ডাটা হজমশক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল ত্বকের জন্য উপকারী এবং রক্তের কোলেস্টেরল কমায়। গাঁটে ব্যথা, বাতরোগ, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া, ও শ্বাসকষ্টে এই গাছের বিভিন্ন অংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
অনেকে শুকনো পাতার গুঁড়া খেতে ব্যবহার করেন। এটি হারবাল সাপ্লিমেন্ট হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। বাজারে বর্তমানে ১০০ গ্রাম শুকনো সাজনা পাতা গুঁড়ার দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
সতর্কতার সঙ্গে বলতে হয়, গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সাজনার মূল বা শিকড় এড়িয়ে চলা উচিত। অতিরিক্ত খেলে কিছু সময়ের জন্য ডায়রিয়া বা হজমে সমস্যা হতে পারে। তাই পরিমিত ব্যবহারে এ গাছ উপকারই করে।
সাজনা গাছের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
সাজনা গাছের চাহিদা শুধু পারিবারিক ব্যবহারে সীমাবদ্ধ নয়, এর ডাটা, পাতা, ফুল ও বীজের জন্য দেশে-বিদেশে ক্রমবর্ধমান চাহিদা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশে এই গাছের বাণিজ্যিক চাষ একটি লাভজনক খাত হিসেবে বিকাশ লাভ করছে।
বাজার চাহিদা ও দাম
সাধারণত বাজারে ১ কেজি তাজা সাজনা ডাটার দাম মৌসুমভেদে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত হয়। পাতা বিক্রি হয় শুকিয়ে গুঁড়া আকারে, যা হারবাল পণ্য হিসেবে জনপ্রিয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে যেমন চাহিদা রয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সাজনা পাতা ও বীজ রপ্তানি করা হচ্ছে।
একজন কৃষক যদি প্রতি বিঘায় ৮০-১০০ গাছ রোপণ করেন, তবে মৌসুমে গড়ে ২০০-৩০০ কেজি ডাটা এবং ৫০-৬০ কেজি শুকনো পাতা উৎপাদন করতে পারেন। এর মাধ্যমে বছরে একাধিকবার আয় করা সম্ভব।
শিল্প খাতে ব্যবহার
বর্তমানে সাজনা গাছ বিভিন্ন শিল্প খাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। হারবাল ওষুধ, প্রসাধনী, পুষ্টি সাপ্লিমেন্ট, চা, স্কিন কেয়ার পণ্যসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবামূলক পণ্যে সাজনার পাতা ও বীজ ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্র শিল্প গড়তে সাজনা চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
সাজনা বীজ থেকে তৈরি তেল “Ben Oil” নামে পরিচিত, যা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এই তেল ব্যবহৃত হয় খাবার, প্রসাধনী এবং ওষুধ তৈরিতে।
নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
গ্রামবাংলায় বহু নারী সাজনা পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে বিক্রি করছেন। এতে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং পারিবারিক অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। সাজনা গাছের এই বহুমুখী ব্যবহার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
সাজনা গাছ বনজ সম্পদ ও পরিবেশগত গুরুত্ব
সাজনা গাছ শুধু পুষ্টির উৎস নয়, এটি পরিবেশ সংরক্ষণ ও মাটির গুণগত মান উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি
সাজনা গাছের পাতা পড়ে মাটিতে পচে গিয়ে জৈবসার হিসেবে কাজ করে। এতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে। যারা জৈব কৃষিতে আগ্রহী, তাদের জন্য সাজনা গাছ অত্যন্ত কার্যকর।
কার্বন শোষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ
সাজনা গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এটি বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায় এবং দূষণ কমাতে সাহায্য করে। শহরের দুষিত বাতাসে ছাদবাগানে সাজনা গাছ লাগালে বাতাস কিছুটা পরিষ্কার থাকে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষা
এই গাছে মৌমাছি, প্রজাপতি, পাখি এবং নানা উপকারী পোকামাকড়ের আনাগোনা দেখা যায়, যা পরিবেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। সাজনা ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে, যা একদিকে মধু উৎপাদনের পথ খুলে দেয়, অন্যদিকে পরাগায়ণের মাধ্যমে কৃষির উন্নতি সাধন করে।
সাজনা গাছ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা
সাজনা গাছ নিয়ে বর্তমানে দেশি-বিদেশি অনেক গবেষণা হচ্ছে। বিশেষ করে এর পুষ্টিগুণ, ঔষধি ক্ষমতা ও পরিবেশগত অবদান নিয়ে গবেষকরা নতুন নতুন তথ্য তুলে ধরছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) সাজনা গাছের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, যেমন BARI Moringa-1। এই জাত থেকে উচ্চফলন এবং রোগ প্রতিরোধী গুণ পাওয়া যায়। এর ফলন প্রতি গাছে বছরে ৩০-৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সাজনা পাতায় মিল্ক প্রোডাকশন বাড়ানোর উপাদান রয়েছে, যা দুগ্ধজাত প্রাণীর খাদ্যে ব্যবহারযোগ্য। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া এবং আইসিডিডিআর,বি-র কিছু গবেষণা বলছে, সাজনা ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, সাজনা পাতার নির্যাস অ্যান্টি-ক্যান্সার, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল গুণসম্পন্ন। ভবিষ্যতে এটি আরও আধুনিক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
সাজনা গাছ চাষে সরকার ও এনজিও-র ভূমিকা
সাজনা গাছের গুণাগুণ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বিবেচনায় সরকার ও বিভিন্ন এনজিও এর চাষে উৎসাহ দিচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE) বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও চারা বিতরণ কর্মসূচি চালু করেছে যাতে কৃষকরা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষ করতে পারে।
বিশেষ করে উপকূলীয় ও খরা প্রবণ এলাকাগুলোতে সাজনা চাষে বিশেষ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে কম পানি ও খারাপ মাটিতেও সাজনা ভালো জন্মায়, ফলে কৃষকদের জন্য এটি একটি কার্যকর বিকল্প ফসল হয়ে উঠেছে।
ব্র্যাক, আশা, প্রান-আরএফএল ফাউন্ডেশনসহ কিছু এনজিও সাজনা চাষে ক্ষুদ্র ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। নারীদের আত্মকর্মসংস্থানে এই উদ্যোগগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
প্রযুক্তিগত সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে— যেমন মোবাইল অ্যাপ বা অনলাইন গাইডলাইনের মাধ্যমে কৃষকদের চাষাবাদ ও রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা হচ্ছে।
আর পড়ুন: ওক গাছ
উপসংহার
সাজনা গাছ একাধারে একটি পুষ্টিকর খাদ্য, ঔষধি গাছ, পরিবেশবান্ধব বনজ সম্পদ এবং সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ফসল। এর চাষাবাদ সহজ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম এবং উপকারিতা অপরিসীম। বাংলাদেশে এর চাষ ও ব্যবহার আরও বিস্তৃত হলে, দেশের পুষ্টি ঘাটতি দূর হবে, কৃষকের আয় বাড়বে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে।
সাজনা গাছ নিয়ে আরও জানুন, নিজের এলাকায় একটি গাছ লাগান এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করুন। যদি এই আর্টিকেলটি আপনাকে উপকারে আসে, তবে শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।