লাকি বাম্বু গাছের পরিচর্যা – টিপস, খাবার ও রোগ প্রতিকার

লাকি বাম্বু গাছের পরিচর্যা

লাকি বাম্বু ফেং শুই সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ যা সৌভাগ্য এবং ইতিবাচক শক্তি আনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এ গাছটি শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না বরং অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে প্রশান্তিদায়ক করে তোলে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এটি বেশ সহজেই মানিয়ে নেয় যা এটিকে ইনডোর গাছ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছে। মাটি ছাড়াও কেবলমাত্র পানি ব্যবহার করে এই গাছের পরিচর্যা করা যায় যা একে অন্যান্য ইনডোর গাছ থেকে আলাদা করে। এ আর্টিকেলে আমরা লাকি বাম্বু গাছের পরিচর্যা, চারা তৈরির পদ্ধতি এবং কাটিং-এর মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

আর পড়ুন: আখরোট গাছ 

লাকি বাম্বু গাছের পরিচিতি

লাকি বাম্বুর উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব

লাকি বাম্বু গাছ মূলত চীনা সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত। চীনের ফেং শুই দর্শনে এই গাছকে সৌভাগ্য, শান্তি এবং দীর্ঘায়ুর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ধারণা করা হয় ঘরে বা কর্মস্থলে এই গাছ রাখলে ইতিবাচক শক্তি বাড়ে এবং নেতিবাচকতা দূর হয়। ফেং শুই অনুসারে এই গাছের শাখার সংখ্যা বিশেষ অর্থ বহন করে। উদাহরণস্বরূপ দুই শাখা প্রেমের প্রতীক, তিন শাখা সুখ, দীর্ঘায়ু ও ধন-সম্পদের প্রতীক এবং পাঁচ শাখা স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

লাকি বাম্বুর বৈজ্ঞানিক নাম ও শ্রেণিবিন্যাস

লাকি বাম্বুর বৈজ্ঞানিক নাম Dracaena sanderiana। এটি প্রকৃতপক্ষে বাঁশ প্রজাতির গাছ নয় বরং এটি Dracaena পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। যদিও এর নাম এবং গঠন বাঁশের মতো মনে হয় এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাছটি সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

লাকি বাম্বু গাছের বিভিন্ন ধরণ

সরল ডান্ডার লাকি বাম্বু

সরল ডান্ডার লাকি বাম্বু হলো সবচেয়ে সাধারণ প্রজাতি যা একক ডান্ডা বা একাধিক স্তম্ভ আকারে পাওয়া যায়। এই ধরনের গাছ সাধারণত টেবিলের কোণে বা ছোট বাগানের অংশ হিসেবে রাখা হয়। এর দাম বাংলাদেশে আকার ও পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত একটি সরল ডান্ডার গাছের দাম ৮০ থেকে ১৫০ টাকা।

বেঁকানো ডান্ডার লাকি বাম্বু

এই ধরনের গাছগুলোর ডান্ডা বিশেষভাবে মোচড়ানো বা বাঁকানো হয় যা দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এগুলো ফেং শুই অনুসারে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বাঁকানো ডান্ডার লাকি বাম্বু সাধারণত একটু ব্যয়বহুল এবং একটি ডান্ডার দাম ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

অন্যান্য আকৃতির লাকি বাম্বু

বিভিন্ন আকৃতির লাকি বাম্বু, যেমন হৃদয় আকৃতি, সর্পিল আকৃতি এবং পিরামিড আকারে সাজানো বাম্বু গাছ আধুনিক ইনডোর সজ্জায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই ধরনের গাছের মূল্য বাংলাদেশের বাজারে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে থাকতে পারে। এই প্রকার গাছগুলো সাধারণত বিশেষ অর্ডারে পাওয়া যায়।

আর পড়ুন: গাছ কাটার আইন ২০২৪ 

লাকি বাম্বু গাছের চারা তৈরি

লাকি বাম্বু চারা তৈরির উপকরণ

লাকি বাম্বু চারা তৈরি করতে প্রয়োজন হয় স্বাস্থ্যবান ডান্ডা, কাঁচি এবং পরিস্কার পানি। আপনি যদি মাটির মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করতে চান তবে ভালো মানের জৈব সার ও বেলে মাটি ব্যবহার করা যায়।

চারা তৈরির ধাপসমূহ

  • উপযুক্ত ডান্ডা নির্বাচন: গাছের সবুজ ও স্বাস্থ্যবান ডান্ডা নির্বাচন করুন।
  • কাটা ও প্রস্তুত করা: কাঁচি দিয়ে ডান্ডা ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে নিন। কাটা অংশে rooting hormone ব্যবহার করলে দ্রুত শেকড় গজাবে।
  • পানিতে বসানো: কাটা ডান্ডা একটি কাঁচের গ্লাস বা বাটি ভর্তি পানি রাখুন। নিশ্চিত করুন যে পানি ২-৩ দিন অন্তর বদলানো হচ্ছে।
  • শেকড় গজানোর প্রক্রিয়া: ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে ডান্ডার নিচের অংশে শেকড় গজাবে। শেকড় গজানোর পর এটি মাটি বা পানি যেকোনো মাধ্যমে রোপণ করা যায়।

চারা তৈরি করে আপনি চাইলে গাছটি নিজের বাড়ির জন্য রাখতে পারেন বা বিক্রির মাধ্যমে আয় করতে পারেন। বাংলাদেশের বাজারে একটি চারার দাম সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে হয়।

লাকি বাম্বু গাছের কাটিং পদ্ধতি

কাটিং এর জন্য উপযুক্ত সময় ও ডান্ডা নির্বাচন

লাকি বাম্বু গাছের কাটিং পদ্ধতি গাছের বংশবৃদ্ধি এবং আকৃতি সংরক্ষণে অত্যন্ত কার্যকর। কাটিং করার জন্য বসন্ত বা গ্রীষ্মকাল হলো উপযুক্ত সময় কারণ এই ঋতুতে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্যবান ও সবুজ ডান্ডা নির্বাচন করতে হবে যাতে শেকড় গজানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। একটি ডান্ডার নিচের অংশে ৩-৪টি গিঁট (nodes) থাকা উচিত কারণ শেকড় সাধারণত এই গিঁট থেকেই বের হয়।

কাটিং পরে গাছের যত্ন নেওয়ার ধাপ

কাটিং করার পর ডান্ডার নিচের অংশটি মসৃণভাবে ছেঁটে নিতে হবে যাতে কোনো ফাটল বা দাগ না থাকে। শেকড় দ্রুত গজানোর জন্য ডান্ডার কাটা অংশে rooting hormone লাগানো যেতে পারে। এর পর কাঁচের গ্লাস বা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পাত্রে পরিষ্কার পানি ভরে ডান্ডাটি ডুবিয়ে রাখতে হবে। পানি অবশ্যই প্রতি ২-৩ দিনে পরিবর্তন করতে হবে যাতে শেকড় দ্রুত এবং সুস্থভাবে গজায়। পানির পরিবর্তে চাইলে বেলে মাটিতে রোপণ করা যায় তবে সেই ক্ষেত্রে মাটি মাঝেমধ্যে ভেজা রাখতে হবে। যত্নের অভাবে গাছটি মরে যেতে পারে তাই সঠিক আলো, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা নিশ্চিত করা জরুরি।

লাকি বাম্বু গাছের পরিচর্যা

লাকি বাম্বু গাছের খাবার ও সার

লাকি বাম্বু গাছের বৃদ্ধির জন্য খুব বেশি খাবারের প্রয়োজন হয় না তবে মাঝে মাঝে তরল সার ব্যবহার করা যেতে পারে। পানি-ভিত্তিক পরিবেশে থাকা লাকি বাম্বু গাছের জন্য নির্দিষ্ট hydroponic plant fertilizer ব্যবহার করা ভালো। প্রতি ৬-৮ সপ্তাহে ২-৩ ফোঁটা তরল সার পানিতে মিশিয়ে দিলে গাছের শেকড় ও ডান্ডা সবল হয়। মাটিতে রোপিত লাকি বাম্বুর জন্য জৈব সার এবং কম নাইট্রোজেনযুক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা উত্তম। বাংলাদেশের বাজারে একটি ছোট বোতল তরল সারের দাম সাধারণত ১০০-২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

আলো ও তাপমাত্রা

লাকি বাম্বু ইনডোর গাছ হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এটি পর্যাপ্ত পরোক্ষ আলো পছন্দ করে। এটি সরাসরি সূর্যালোক পেলে পাতা পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ গাছটি ১৮-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালো থাকে যা বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই। তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে বা কমে গেলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

পানি দেওয়ার নিয়ম

পানি লাকি বাম্বু গাছের মূল খাদ্য। পানি অবশ্যই ফিল্টার করা বা বিশুদ্ধ হতে হবে কারণ ক্লোরিনযুক্ত পানি গাছের শেকড়ের ক্ষতি করতে পারে। পানিতে ডান্ডার নিচের অংশ ডুবানো থাকবে। তবে সম্পূর্ণ ডান্ডা পানির নিচে রাখার প্রয়োজন নেই। প্রতি সপ্তাহে পানি বদলানো বাধ্যতামূলক যাতে কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক জন্মাতে না পারে।

আর পড়ুন: ছাদ বাগানের জন্য উপযুক্ত গাছ 

লাকি বাম্বু গাছের ইনডোর পরিচর্যা টিপস

পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস নিশ্চিত করা

যদিও লাকি বাম্বু অল্প আলোতেও বেঁচে থাকতে পারে তবে এটি পর্যাপ্ত আলো পেলে সতেজ এবং সবুজ থাকে। গাছটি এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে না তবে প্রচুর প্রাকৃতিক আলো প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া ঘরের ভেতরে গাছ রাখলে মাঝে মাঝে তাজা বাতাসের সংস্পর্শে রাখতে হবে যাতে শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কাজ করে।

গাছের অবস্থান পরিবর্তন সম্পর্কিত পরামর্শ

লাকি বাম্বু খুব বেশি অবস্থান পরিবর্তন পছন্দ করে না। একবার একটি স্থানে রাখার পর সেটি বেশিরভাগ সময় সেখানেই রাখা উচিত। তবে যদি আলো বা পরিবেশের কারণে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তখন এটি এমন জায়গায় স্থানান্তর করা উচিত যেখানে পর্যাপ্ত আলো এবং তাপমাত্রা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের গরম মৌসুমে গাছকে ঠান্ডা স্থানে রাখা ভালো।

লাকি বাম্বু গাছের রোগ ও প্রতিকার

পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া

লাকি বাম্বু গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত আলো, ক্লোরিনযুক্ত পানি বা অতিরিক্ত সার প্রয়োগ। যদি পাতা হলুদ হয়ে যায় তবে গাছটি সরাসরি সূর্যালোক থেকে দূরে রাখতে হবে। পানির উৎস পরিবর্তন করে ফিল্টার বা বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে সারের পরিমাণ কমিয়ে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করতে হবে।

ডান্ডা পচে যাওয়া

ডান্ডা পচে যাওয়া সাধারণত বেশি পানিতে ডুবে থাকার কারণে হয়। এ সমস্যা দেখা দিলে পচে যাওয়া অংশটি কেটে ফেলে ডান্ডার সুস্থ অংশটি আবার শেকড় গজানোর জন্য পরিষ্কার পানিতে রাখতে হবে। এ ছাড়া পানি পরিষ্কার এবং নিয়মিত বদলানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

কীটপতঙ্গজনিত সমস্যা

লাকি বাম্বুতে মাকড়সার মতো ছোট কীটপতঙ্গের আক্রমণ হতে পারে। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পাতাগুলো সাবান মিশ্রিত পানি দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে। মৃদু কীটনাশক স্প্রে করাও উপকারী হতে পারে তবে ইনডোর গাছের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক এড়িয়ে চলা উচিত।

প্রতিকারের উপায়

গাছের সুস্থতা বজায় রাখতে নিয়মিত পরিচর্যা করা জরুরি। পানি এবং আলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে গাছটি পরিষ্কার রাখতে হবে। গাছের আশপাশে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত করা হলে রোগের ঝুঁকি কমে যায়।

লাকি বাম্বু গাছের পরিচর্যা

লাকি বাম্বু গাছ কেনার আগে করণীয়

গাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা

লাকি বাম্বু কিনতে গেলে প্রথমেই গাছের ডান্ডা ও পাতার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। ডান্ডা সবুজ, মসৃণ এবং দৃঢ় হওয়া উচিত। পাতাগুলো উজ্জ্বল সবুজ ও তাজা হলে তা গাছের ভালো অবস্থার পরিচায়ক। পাতা বা ডান্ডায় যদি কোনো দাগ বা পচা অংশ দেখা যায় তবে তা কিনবেন না।

ক্রয়ের সঠিক স্থান নির্বাচন

বিশ্বস্ত নার্সারি বা বাগান দোকান থেকে লাকি বাম্বু কিনতে হবে যেখানে গাছের মান নিশ্চিত করা হয়। অনলাইনে কিনতে চাইলে বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট থেকে অর্ডার করা ভালো। বাংলাদেশের বাজারে সরল ডান্ডার একটি লাকি বাম্বুর দাম ৮০-১৫০ টাকা আর বিশেষ আকৃতির গাছগুলোর দাম ৫০০-২০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে।

আর পড়ুন: কাঠের বলের দাম কত – জানুন বিস্তারিত

উপসংহার

লাকি বাম্বু গাছ শুধুমাত্র ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না বরং একটি সুস্থ এবং ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতেও ভূমিকা রাখে। এই গাছটি খুব সহজে রোপণ করা যায় এবং যত্ন নিতে খুব বেশি সময় বা প্রচেষ্টা প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের ঘরোয়া পরিবেশে এই গাছটি মানিয়ে নিতে সক্ষম যা একে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। নিয়মিত পরিচর্যা এবং সঠিক পদ্ধতিতে যত্ন নিলে লাকি বাম্বু গাছ দীর্ঘদিন সুস্থ এবং সতেজ থাকবে।

পরিশেষে গাছপ্রেমী পাঠকদের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যেন এই গাছের যত্ন নেওয়ার প্রক্রিয়া শেয়ার করেন এবং নতুন করে গাছপালার যত্ন সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *