লরেল গাছ – গুণাগুণ, ব্যবহার ও বিস্ময়কর দীর্ঘজীবন

লরেল গাছ

লরেল গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম: Laurus nobilis) একটি সুগন্ধি চিরহরিৎ গাছ যা মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের আদিবাসী। এটি তেজপাতা গাছ নামেও পরিচিত, যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত তেজপাতা ও আসল লরেল গাছ আলাদা উদ্ভিদ হতে পারে। ইংরেজিতে একে বলা হয় “Bay Laurel”। এটি লরেসি (Lauraceae) পরিবারের সদস্য। ইতিহাসে, সাহিত্য ও চিকিৎসাশাস্ত্রে এই গাছের গুরুত্ব বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান।

“লরেল” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ laurus থেকে, যার অর্থ বিজয়, সম্মান বা মর্যাদা। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় লরেল গাছ ছিল বিজয়ের প্রতীক। অলিম্পিকে জয়ীদের মাথায় পরানো হতো লরেল পত্রমাল্য—যাকে বলা হতো “Laurel Wreath”। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর প্রতীক হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হতো। তাই এই গাছ শুধু নয়, এর পাতা, মাল্য ও সৌরভ বহু অর্থ বহন করে।

আর পড়ুন:গেওয়া গাছ 

হাজার বছর আগে থেকেই লরেল পাতা ব্যবহার হতো চিকিৎসা, সুগন্ধি ও রান্নায়। এই গাছের ঔষধিগুণ এতটাই বিস্তৃত যে আজও বিভিন্ন দেশে এটি আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ও আধুনিক ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে লরেল গাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে।

লরেল গাছ দেখতে কেমন

লরেল গাছ দেখতে অত্যন্ত পরিপাটি ও ছিমছাম। এটি গড়পড়তা ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় বেড়ে ওঠে, তবে অনুকূল পরিবেশে এটি ৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এর গঠন কিছুটা শঙ্কু বা ডিম্বাকৃতি আকৃতির এবং পাতাগুলো ঘন ও মসৃণভাবে ছড়ানো থাকে। এই গাছের ছাল ধূসরাভ ও পাতলা, এবং ডালগুলো নমনীয় ও সামান্য ঘন।

পাতা দেখতে গাঢ় সবুজ, মসৃণ ও কিছুটা চকচকে। প্রতিটি পাতা লম্বায় প্রায় ২.৫ থেকে ৫ ইঞ্চি হয়ে থাকে। পাতার গায়ে তেলযুক্ত কোষ থাকে, যা ছিঁড়লেই সুগন্ধ বের হয়। এই পাতাগুলোকেই আমরা তেজপাতা হিসেবে চিনি এবং রান্নায় ব্যবহার করি। লরেল পাতার ঘ্রাণ একটু তিক্ত ও মশলাদার ধরনের, ঠিক যেনো মিশ্র সুগন্ধির অনুভব।

লরেল গাছ বসন্তকালে ছোট ছোট হলুদাভ-সাদা রঙের ফুল ফোটায়। এই ফুলগুলি সাধারণত গুচ্ছাকারে ফোটে এবং দেখতে সাদামাটা হলেও এগুলো থেকে পরে ছোট কালচে-বেগুনি ফল হয়। এই ফলগুলি পাকা অবস্থায় অনেক সময় তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যা ভেষজ গুণসম্পন্ন।

লরেল গাছের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর পাতার ঘনত্ব ও সুগন্ধি। বাগানে বা রাস্তাঘাটের ধারে সাজানো অবস্থায় এই গাছ একটি অনন্য রুচিশীল পরিবেশ তৈরি করে। এর গঠনবিন্যাস এমন যে একে শোভামূলক গাছ হিসেবেও শহুরে বাগান ও ছাদবাগানে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

লরেল গাছ দেখতে কেমন

লরেল গাছ কত বছর বাঁচে

লরেল গাছের আয়ু অন্যান্য গাছের তুলনায় তুলনামূলক দীর্ঘ। প্রাকৃতিক পরিবেশে এই গাছ ৫০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। উন্নত পরিচর্যা এবং সঠিক পরিবেশে এটি আরও বেশি বছর টিকে থাকতে সক্ষম। কিছু ক্ষেত্রে, ইউরোপীয় পুরাতন উদ্যান বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে ১৫০ বছর বয়সী লরেল গাছের উদাহরণ পাওয়া যায়।

একটি লরেল গাছ সাধারণত ৫-৭ বছর বয়সে পূর্ণ পরিণতিতে পৌঁছে এবং তখন থেকে নিয়মিতভাবে পাতা উৎপন্ন করে। যারা বাণিজ্যিকভাবে লরেল গাছের পাতা বিক্রি করেন, তারা বছরে একাধিকবার ছাঁটাই করে পাতাগুলো সংগ্রহ করেন। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে ১.৫ থেকে ২ কেজি পর্যন্ত শুকনো তেজপাতা দিতে পারে।

লরেল গাছের আয়ু মূলত নির্ভর করে নিচের বিষয়গুলোর উপর:

  • পরিবেশ: উষ্ণ ও সুনিয়ন্ত্রিত আর্দ্রতা থাকলে গাছ দীর্ঘজীবী হয়।

  • মাটি: জলাধারযুক্ত, সুনিষ্কাশিত ও হালকা অম্লধর্মী মাটি লরেল গাছের জন্য আদর্শ।

  • পরিচর্যা: নিয়মিত পানি দেওয়া, সার প্রয়োগ ও ছাঁটাই করলে গাছ দীর্ঘদিন সুস্থ থাকে।

  • পোকামাকড় ও রোগ: সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিলে পাতা ঝরে যেতে পারে বা গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।

আধুনিক হর্টিকালচার অনুযায়ী, গাছের কৃত্রিম ছাঁটাই (Topiary) করেও আয়ু বাড়ানো যায় এবং গাছকে বিভিন্ন কাঠামোতে গড়ে তোলা যায়, যেমন – গোলাকার, শঙ্কু ইত্যাদি।

লরেল গাছ কোথায় পাওয়া যায়

লরেল গাছের আদিবাস মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল হলেও বর্তমানে এটি ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকার বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্পেন, ইটালি, তুরস্ক, গ্রিস, ফ্রান্স, মরক্কো ও লেবানন — এই দেশগুলোতে প্রাকৃতিক ও বাণিজ্যিকভাবে লরেল গাছ চাষ হয়।

বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত লরেল বন হচ্ছে স্পেন ও পর্তুগালের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত Laurisilva বন। এটি UNESCO World Heritage Site হিসেবে স্বীকৃত একটি প্রাকৃতিক বন। এই লরেল বন প্রায় ২০ মিলিয়ন বছর পুরাতন এবং পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন চিরহরিৎ বনগুলোর একটি। এখানে প্রচুর পরিমাণে মৌলিক প্রজাতির লরেল জাতীয় গাছ জন্মায়, যেগুলোর অনেকগুলোই বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশে আসল Laurus nobilis গাছ খুব বেশি প্রচলিত না হলেও তেজপাতা গাছ নামে পরিচিত একাধিক প্রজাতি পাওয়া যায়, যেমন — Cinnamomum tamala, যেটি আমরা সাধারণত রান্নায় ব্যবহার করি। এগুলোও লরেল পরিবারের সদস্য এবং এদের পাতা থেকেও সুগন্ধি পাওয়া যায়।

এছাড়া বাংলাদেশের বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ এবং কিছু নার্সারিতে পরীক্ষামূলকভাবে লরেল গাছ চাষ হচ্ছে। ইদানীং ছাদবাগান বা টবের মধ্যে বিদেশি প্রজাতির সুগন্ধি গাছ হিসেবে কেউ কেউ লরেল গাছ রোপণ করছেন।

দাম ও বাজারপ্রাপ্তি:
লরেল গাছ বাংলাদেশে এখনো বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত না হলেও অনলাইন নার্সারি ও কিছু প্রিমিয়াম নার্সারিতে পাওয়া যায়। ছোট চারা গাছের দাম প্রায় ৩০০–৬০০ টাকা, আর এক থেকে দুই বছর বয়সী গাছের দাম হতে পারে ৮০০–১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ইউরোপে লরেল পাতা শুকিয়ে প্রতি কেজি ১৫–২৫ ইউরো দামে বিক্রি হয়। বাংলাদেশে আমদানি করা প্যাকেটজাত তেজপাতা ১০০ গ্রাম প্যাকেটের দাম প্রায় ৫০–৭০ টাকা।

আর পড়ুন:পিস লিলি গাছ

লরেল পাতার ঔষধি গুণাগুণ

লরেল গাছের পাতা কেবল রান্নার সুগন্ধি উপাদান হিসেবেই নয়, বরং বহুমুখী ঔষধি গুণাগুণের জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত। প্রাচীন গ্রীক, রোমান, ভারতীয় আয়ুর্বেদ ও মধ্যপ্রাচ্যীয় ইউনানি চিকিৎসাশাস্ত্রে লরেল পাতাকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আজকের আধুনিক ভেষজ চিকিৎসাতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রথমত, লরেল পাতা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিফাঙ্গালঅ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণসম্পন্ন। এতে উপস্থিত থাকা “ইউজেনল” নামক যৌগ জ্বর ও ব্যথা উপশমে সহায়ক। ঠান্ডা-কাশি বা সর্দিতে আক্রান্ত হলে গরম পানিতে লরেল পাতা দিয়ে ভাপ নেওয়া উপকারী।

হজমে সহায়ক:
লরেল পাতা হজমশক্তি বাড়ায়, গ্যাস ও বদহজমে উপশম করে। এতে থাকা এনজাইম হজম প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। যারা অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার খেয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন, তাদের জন্য লরেল পাতা একটি প্রাকৃতিক প্রতিকার।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ লরেল পাতা খেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি নিয়মিত গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ত্বক ও চুলের যত্নে:
লরেল পাতার তেল ব্রণ ও ফুসকুড়ির জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে থাকা অ্যান্টিসেপ্টিক উপাদান ত্বক পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে। চুলে ব্যবহারে খুশকি কমে ও চুলের গোড়া মজবুত হয়। অনেকে লরেল পাতা ফুটিয়ে তার পানি দিয়ে মুখ ধোয়ার পরামর্শ দেন, যা প্রাকৃতিক স্কিনটোনার হিসেবে কাজ করে।

লরেল গাছের কাঠ, ছাল ও পাতা – ব্যবহারিক দিক

লরেল গাছ শুধু ঔষধি বা সুগন্ধির জন্য নয়, বরং এর কাঠ, ছাল ও পাতাও বহুমুখী ব্যবহারে উপযোগী। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বহু দেশে এই গাছের বিভিন্ন অংশ ঘরোয়া কাজ, খাদ্য প্রস্তুত ও হস্তশিল্পে ব্যবহৃত হয়।

কাঠের ব্যবহার:
লরেল গাছের কাঠ শক্ত, টেকসই ও নান্দনিক দৃষ্টিতে চমৎকার। এই কাঠ সাধারণত ছোট আসবাবপত্র, হস্তশিল্প ও ছুরি-মাছ ধরার হ্যান্ডেলে ব্যবহৃত হয়। কাঠের গায়ে হালকা সুবাস থাকে এবং এটি খুব সহজে পালিশযোগ্য, যা শিল্পীদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।

ছাল ও শিকড়:
গাছের ছাল ও শিকড় থেকে প্রাকৃতিক রঙ ও সুগন্ধি নির্গত করা যায়। ঐতিহাসিকভাবে এগুলো ত্বকের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। হালকা ছত্রাকজনিত সমস্যা বা চুলকানিতে লরেল ছাল সিদ্ধ করে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

রান্নায় পাতা ব্যবহার:
লরেল পাতা রান্নার অন্যতম পরিচিত সুগন্ধি উপাদান। খিচুড়ি, ভুনা, বিরিয়ানি, স্ট্যু বা ঝোলজাতীয় রান্নায় লরেল পাতা ব্যবহৃত হয়। এটি রান্নায় একটা মৃদু, স্নিগ্ধ সুগন্ধ ছড়ায়, যা খাবারকে রুচিকর করে তোলে। তাছাড়া, এটি চর্বি হজমে সহায়তা করে, যার ফলে তৈলাক্ত খাবারে এর ব্যবহার স্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত হয়।

প্রাকৃতিক সুগন্ধি ও পোকামাকড় তাড়াতে:
শুকনো লরেল পাতা ঘরে ঝুলিয়ে রাখলে মশা, তেলাপোকা ও ছারপোকা দূরে থাকে। অনেকেই আলমারি বা জামার তাকে লরেল পাতা রাখেন, যাতে পোকার উপদ্রব না হয় এবং কাপড়ে প্রাকৃতিক ঘ্রাণ থাকে।

লরেল গাছের চাষ পদ্ধতি

লরেল গাছের চাষ তুলনামূলকভাবে সহজ এবং যে কেউ চাইলে বাড়ির বাগান বা টবে এটি রোপণ করতে পারেন। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে চাইলে কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।

মাটি ও জলবায়ু:
লরেল গাছ উষ্ণ, আর্দ্র ও রোদেলা পরিবেশে ভালো জন্মে। মাটি হওয়া উচিত হালকা অম্লধর্মী, সুনিষ্কাশিত এবং পুষ্টিকর। বেশি পানি জমে থাকলে গাছের শিকড় পচে যেতে পারে, তাই উচ্চভূমি বা একটু উঁচু জায়গায় চাষ উত্তম। পিএইচ মান ৬.৫–৭.৫ এর মধ্যে হলে লরেল ভালো বৃদ্ধি পায়।

চারা রোপণ ও ছাঁটাই:
লরেল গাছ বীজ বা কাটিং থেকে চারা করে রোপণ করা যায়। বীজ থেকে রোপণের সময় অঙ্কুরোদ্গমে ৪–৬ সপ্তাহ লাগে। তবে কাটিং পদ্ধতিতে দ্রুত ফল পাওয়া যায়। ছাঁটাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি গাছের গঠন সুন্দর রাখে এবং পাতা উৎপাদন বাড়ায়।

সার ও পানি:
প্রতি ২ মাস অন্তর জৈব সার বা পচা গোবর মাটি চাষের জায়গায় মেশালে গাছ স্বাস্থ্যবান হয়। প্রয়োজন অনুসারে পানি দিতে হবে, তবে অতিরিক্ত পানি দেওয়া যাবে না। বর্ষাকালে পানি জমে গেলে তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগ প্রতিকার:
লরেল পাতায় মাঝে মাঝে “scale insects” বা “aphids” আক্রমণ করতে পারে। এসব প্রতিরোধে নিম তেল স্প্রে করা যেতে পারে। ছত্রাক বা দাগজনিত সমস্যা হলে কপার ভিত্তিক ফাঙ্গিসাইড ব্যবহার করতে হবে।

শহরে ও টবে লরেল গাছ

ব্যস্ত শহরে যেখানে জায়গার অভাব, সেখানে টবে বা ছাদে লরেল গাছ চাষ হতে পারে চমৎকার এক পরিবেশবান্ধব সমাধান। লরেল গাছের শিকড় অগভীর হওয়ায় এটি সহজেই টবে বেড়ে উঠতে পারে এবং সাধারণত তেমন বড় হয় না, ফলে ছাদবাগানের জন্য উপযুক্ত।

টবে চাষের পদ্ধতি:
প্রথমে একটি মাঝারি (১২–১৮ ইঞ্চি) মাপের টব বেছে নিতে হবে। নিচে ছিদ্রযুক্ত অংশ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাটিতে ৫০% দোআঁশ, ৩০% জৈব সার ও ২০% বালি মিশিয়ে টব ভরতে হবে। চারা রোপণের পর সরাসরি সূর্যালোকে রেখে নিয়মিত পানি দিতে হবে।

পরিবেশ বিশুদ্ধকরণ:
লরেল গাছ শুধু অক্সিজেন তৈরি করে না, বরং ঘরের বাতাস থেকে কিছু দূষিত পদার্থ শোষণ করে নেয় বলে ধারণা করা হয়। তাই যেসব বাসাবাড়িতে বাচ্চা, বয়স্ক বা অ্যাজমার রোগী আছেন, সেখানে এই গাছ রাখা উপকারী হতে পারে।

সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা:
লরেল গাছের পাতা ঘন এবং ছাঁটাই করে যেকোনো আকৃতি দেওয়া যায়, ফলে এটি একটি চমৎকার অলংকার গাছ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। ছাদবাগানে একে শোভামূলক গাছ হিসেবে বা রান্নায় ব্যবহারের জন্য টবেই রাখা যায়।

পরিবেশগত গুরুত্ব ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ভূমিকা

লরেল গাছ শুধু ঔষধি ও শোভামূলক উদ্ভিদ নয়, বরং পরিবেশ রক্ষায় এবং জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে এই গাছের উপস্থিতি একটি পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে।

বনের কার্বন শোষণ ও টিকে থাকার সংগ্রাম:
লরেল গাছ দীর্ঘজীবী এবং ঘন পাতাযুক্ত হওয়ার কারণে এটি বাতাস থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। ক্যানারি দ্বীপের Laurisilva বন বর্তমানে একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু, কারণ সেখানে এমন বহু প্রজাতির লরেল জাতীয় গাছ রয়েছে, যেগুলো ২০ মিলিয়ন বছর ধরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে।

প্রাণীজগতে অবদান:
লরেল গাছের ছায়ায় ছোট পাখি, মৌমাছি, প্রজাপতি ও বিভিন্ন কীটপতঙ্গ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়। ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে এবং পোকামাকড় এর গায়ে ডিম পাড়ে। এর ফলে একটি ছোটখাটো খাদ্যশৃঙ্খল তৈরি হয়, যা একে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদে পরিণত করে।

বন সংরক্ষণে লরেলের প্রয়োজনীয়তা:
বিশ্বব্যাপী বন উজাড় ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে লরেল গাছ এক অনন্য উদাহরণ—যেখানে বনজ উদ্ভিদ টিকিয়ে রেখে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব। এটি চিরসবুজ হওয়ায় সারা বছর পরিবেশে অক্সিজেন সরবরাহে ভূমিকা রাখে এবং বৃষ্টির পানিকে ধরে রাখতে সহায়তা করে।

সাহিত্য, লোকজ বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক প্রতীক

লরেল গাছের পরিচিতি শুধু বিজ্ঞান বা ঔষধিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্ব সাহিত্য, পুরাণ ও লোকাচারে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এটি একটি প্রতীকী উদ্ভিদ, যা বহু কাব্য, চিত্রকলা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে স্থান করে নিয়েছে।

পুরাণ ও সাহিত্যে লরেলের উল্লেখ:
গ্রিক পুরাণে বলা হয়, দেবতা অ্যাপোলো প্রেমে পড়েছিলেন নিফে (nymph) ড্যাফনির। ড্যাফনি অ্যাপোলোকে প্রত্যাখ্যান করলে তিনি লজ্জায় নিজেকে লরেল গাছে রূপান্তরিত করেন। এরপর থেকে অ্যাপোলো লরেল গাছকে সম্মান করেন এবং তাঁর প্রতীক হিসেবে লরেল পত্রমাল্য ধারণ করেন।

“Laurel Wreath” এর প্রতীকী ব্যবহার:
রোমান সভ্যতায় সেনাপতিদের বিজয়ের পর লরেল মুকুট দেওয়া হতো। ইংরেজি ভাষায় “to rest on one’s laurels” মানে অতীতের সাফল্যে গর্বিত থাকা। আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের “laureate” বলা হয় এবং সাহিত্যে “Poet Laureate” উপাধি দেওয়া হয়।

লোকাচারে পাতা ব্যবহার:
বাংলাদেশে অনেকে রান্নার মসলার অংশ হিসেবে যেটিকে “তেজপাতা” বলেন, সেটিও লরেল জাতীয় গাছেরই একটি। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা পূজায় এই পাতার ব্যবহার প্রচলিত। এছাড়া গ্রামে অনেকে বিশ্বাস করেন যে ঘরে শুকনো তেজপাতা রাখলে দুর্ভাগ্য দূর হয়—এ এক লোকজ বিশ্বাস, যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই অংশ।

আর পড়ুন:গেট ফুল গাছ

উপসংহার

লরেল গাছ একটি বিস্ময়কর উদ্ভিদ, যার প্রতিটি অংশই আমাদের জীবনে কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখে। এর পাতা আমাদের খাদ্যে সুগন্ধি যোগ করে, শরীরের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, কাঠ ব্যবহার হয় দৈনন্দিন জীবনে এবং গাছ নিজেই একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক উপাদান।

এই গাছের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সাহিত্যিক মূল্য এবং পরিবেশগত ভূমিকা একে অন্যান্য গাছের চেয়ে আলাদা মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। প্রাচীন সভ্যতা থেকে আজ পর্যন্ত, লরেল গাছ বিজয়, বুদ্ধি ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশে এখনো এর বাণিজ্যিক চাষ তেমনভাবে শুরু না হলেও ভবিষ্যতে এই গাছের সম্ভাবনা প্রচুর। আধুনিক বাগানপন্থায় যারা টবে চাষ করতে চান কিংবা শহরে অল্প জায়গায় পরিবেশবান্ধব গাছ খুঁজছেন—তাদের জন্য লরেল গাছ হতে পারে দারুণ একটি বিকল্প।

আমাদের উচিত লরেল জাতীয় উদ্ভিদ সম্পর্কে সচেতন হওয়া, গবেষণায় উৎসাহী হওয়া এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনে এই গাছকে অন্তর্ভুক্ত করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *