রামবুটান গাছের দাম ও চাষের সম্পূর্ণ বিস্তারিত গাইড

রামবুটান গাছের দাম

রামবুটান (Rambutan) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বিশেষ প্রজাতির ফল যা তার রসালো স্বাদ এবং সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত। এটি দেখতে অনেকটা লিচুর মতো কিন্তু বাইরের আবরণে ছোট ছোট লোম থাকে। বাংলাদেশের গার্হস্থ্য উদ্যান এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান বাজারে রামবুটানের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। – রামবুটান গাছের দাম

বাংলাদেশ ও ভারতে ফল চাষের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া এবং মাটির কারণে রামবুটান গাছ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই আর্টিকেলে আমরা রামবুটান গাছের দাম, পরিচর্যা এবং চাষের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরব।

রামবুটান গাছের বৈশিষ্ট্য

রামবুটান গাছ মাঝারি আকারের যা সাধারণত ১০-২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এটি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় ভালো জন্মায়।

আর পড়ুন: গারকাদ গাছ 

গাছের বৈশিষ্ট্য:

  • পাতা: গাঢ় সবুজ, লম্বাটে এবং মসৃণ।
  • ফল: গোলাকার বা ডিম্বাকৃতি, বাইরের দিকে লালচে হলুদ এবং ছোট লোমযুক্ত।
  • গাছের আয়ু: ২০-২৫ বছর।
  • ফল ধরার সময়: সাধারণত রোপণের ৩-৪ বছরের মধ্যে ফল ধরে।

রামবুটানের বিভিন্ন প্রজাতি:

  • Rambutan Binjai: সুগন্ধি এবং মিষ্টি।
  • Rambutan Lebak Bulus: বড় এবং পুরু শাঁস।
  • Rambutan Rapiah: রসালো এবং সহজে খাওয়া যায়।

এই বৈশিষ্ট্যগুলোই রামবুটানকে লিচু ও লংগানের চেয়ে আলাদা করেছে।

রামবুটান গাছের চারা

রামবুটান গাছের চারা সংগ্রহ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। চারা কেনার সময় বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত কারণ সঠিক মানের চারা ফলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কোথায় পাওয়া যায়

বাংলাদেশে ঢাকা, যশোর এবং সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন নার্সারিতে রামবুটান গাছের চারা সহজলভ্য। ভারতে কেরালা, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক অঞ্চলে রামবুটানের চারাগুলো পাওয়া যায়।

চারা কেনার সময় মনোযোগ দিন:

  • চারাটি যেন শক্ত এবং রোগমুক্ত হয়।
  • উচ্চতায় অন্তত ১-২ ফুট দীর্ঘ চারা কিনুন।
  • গ্রাফটেড (কলম) চারা কিনলে ফলন দ্রুত হবে।

চারার দাম:

  • বাংলাদেশ: একেকটি গ্রাফটেড চারা ৩০০-৫০০ টাকা।
  • ভারত: ২৫০-৪৫০ রুপি।

রামবুটান গাছের দাম

রামবুটান গাছের দাম মূলত এর উচ্চতা, বয়স এবং প্রজাতির ওপর নির্ভর করে। দাম ভিন্নতর হয় শহর এবং গ্রামভিত্তিক নার্সারি অনুসারে।

গাছের দাম নির্ধারণের উপাদান:

  • উচ্চতা: ২-৩ ফুট লম্বা গাছের দাম সাধারণত বেশি হয়।
  • প্রজাতি: গ্রাফটেড গাছের দাম অগ্রাধিকার পায়।
  • বয়স: ১-২ বছর বয়সী গাছ বেশি ফলনশীল হওয়ায় এর দাম বেশি।

বাংলাদেশে রামবুটান গাছের দাম:

  • সাধারণ গাছ: ৫০০-৮০০ টাকা।
  • গ্রাফটেড গাছ: ১,২০০-১,৫০০ টাকা।

ভারতে রামবুটান গাছের দাম:

  • সাধারণ গাছ: ৪৫০-৭০০ রুপি।
  • গ্রাফটেড গাছ: ১,০০০-১,৪০০ রুপি।

আর পড়ুন: বাংলাদেশে কফি গাছ চাষ 

রামবুটান গাছ কোথায় পাওয়া যায়

রামবুটান গাছ সংগ্রহের জন্য সঠিক জায়গা নির্বাচন করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে:

  • ঢাকা: মিরপুর এবং গাজীপুর অঞ্চলে উন্নতমানের নার্সারি।
  • চট্টগ্রাম: পাহাড়ি অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ।
  • অনলাইন: বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যেমন Daraz এবং Facebook নার্সারি গ্রুপ।

ভারতে:

  • কেরালা ও তামিলনাড়ু: এখানকার নার্সারিগুলো উন্নত প্রজাতির রামবুটান গাছ সরবরাহ করে।
  • অনলাইন: Amazon India এবং Flipkart-এ উন্নত মানের চারা কিনতে পাওয়া যায়।

অনলাইনে কেনার সুবিধা ও অসুবিধা:

  • সুবিধা: সময় সাশ্রয় এবং সহজলভ্যতা।
  • অসুবিধা: চারা বা গাছের মানের নিশ্চয়তা কম।

রামবুটান গাছের পরিচর্যা

রামবুটান গাছের সঠিক পরিচর্যা ফলনের গুণগত মান এবং পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাটির ধরন:

  • দোআঁশ মাটি রামবুটান গাছের জন্য আদর্শ।
  • মাটি যেন পানি ধারণক্ষমতা বেশি না হয়।

পানি এবং রোদ:

  • সপ্তাহে ২-৩ বার পানি দিন।
  • পর্যাপ্ত সূর্যালোকের ব্যবস্থা রাখুন কারণ রামবুটান গাছ সরাসরি সূর্যের আলোতে ভালো জন্মায়।

কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ:

  • রামবুটান গাছে প্রায়ই মিলিবাগ এবং পাতা খেকো পোকা আক্রমণ করে।
  • জৈব কীটনাশক ব্যবহার করুন।

অতিরিক্ত টিপস:

  • বছরে অন্তত ১ বার গাছের ডাল ছাঁটাই করুন।
  • ফসফরাস এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ সার ব্যবহার করুন।

রামবুটান গাছ লাগানোর উপায়

রামবুটান গাছের সঠিক ফলনের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে গাছ রোপণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই এমন একটি স্থান নির্বাচন করুন যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পৌঁছায়। রোপণের আগে মাটি ভালোভাবে প্রস্তুত করুন। মাটি হতে হবে দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। চারা লাগানোর আগে মাটিতে জৈব সার মেশাতে হবে যাতে গাছ প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়।

চারা রোপণের সময় অন্তত ১০-১৫ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন কারণ রামবুটান গাছ বড় হয় এবং পর্যাপ্ত স্থান প্রয়োজন। রোপণের পরে চারা প্রথম ছয় মাস নিয়মিত পানি দেওয়া এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে মালচিং ব্যবহার করলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফল ধরার জন্য গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির ৩-৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

রামবুটান গাছের ফলন বৃদ্ধি

রামবুটান গাছ থেকে ভালো ফলন পেতে হলে সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি উন্নত কৌশল অনুসরণ করা প্রয়োজন। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে গাছে জৈব সারের পাশাপাশি এনপিকে (নাইট্রোজেন-ফসফরাস-পটাশিয়াম) সমৃদ্ধ সার ব্যবহার করুন। বছরে অন্তত দুইবার, একবার বর্ষার শুরুতে এবং আরেকবার শীতকালে সার প্রয়োগ করুন।

ডাল ছাঁটাই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যা গাছের বয়স অনুযায়ী করা উচিত। পুরোনো এবং অপ্রয়োজনীয় ডাল ছাঁটাই করলে গাছ বেশি ফল ধরে। প্রাকৃতিকভাবে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম তেল বা জৈব কীটনাশক ব্যবহার করুন। এছাড়াও ফুল ফোটার সময় গাছকে অতিরিক্ত পুষ্টি সরবরাহ করলে ফলের আকার এবং গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।

রামবুটানের স্বাস্থ্য উপকারিতা

রামবুটান শুধু স্বাদেই অনন্য নয় এর স্বাস্থ্য উপকারিতাও অনেক। রামবুটান ফল ভিটামিন সি, আয়রন এবং ফাইবার সমৃদ্ধ। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করে। রামবুটানে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষগুলোর বার্ধক্য রোধে সহায়ক।

রামবুটান হজমশক্তি উন্নত করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এর শাঁস কম ক্যালোরিযুক্ত তাই এটি ডায়েটের জন্য আদর্শ। এই ফল রক্তস্বল্পতার সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে এবং রক্তে আয়রনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এছাড়াও রামবুটানের বীজ থেকেও তেল বের করে তা প্রসাধনী শিল্পে ব্যবহার করা হয়।

 রামবুটান ফলের বাজার মূল্য

রামবুটান একটি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ফল বিশেষত বাংলাদেশ ও ভারতের বাজারে। মৌসুমে ফলটি সাধারণত বেশি পাওয়া যায় এবং তখন এর দাম কিছুটা কম থাকে। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি রামবুটান ৪০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বড় শহরগুলোতে যেমন ঢাকার গুলশান বা কলকাতার নিউ মার্কেটে রামবুটানের দাম প্রায় ৮০০-১,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক বাজারে রামবুটানের দাম আরও বেশি। রপ্তানি করলে প্রতি কেজি রামবুটান প্রায় ৫-১০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়। এর উচ্চ বাজার মূল্য এবং স্বাস্থ্য উপকারিতার কারণে এটি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যে জনপ্রিয়।

রামবুটান চাষের লাভজনকতা

রামবুটান চাষ বাংলাদেশ ও ভারতের কৃষকদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে। এটি চাষে মাটির বিশেষ ধরনের প্রয়োজন নেই। তবে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতি বছর ২০-৩০ কেজি ফল উৎপাদন করা সম্ভব। একটি পূর্ণবয়স্ক রামবুটান গাছ থেকে বছরে ২৫,০০০-৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়।

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে অনেক চাষি ইতোমধ্যে রামবুটান চাষ শুরু করেছেন এবং ভালো ফল পাচ্ছেন। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলের চাষিদের জন্য রামবুটান একটি নতুন সম্ভাবনা হতে পারে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করলে চাষিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারেন।

আর পড়ুন:কারিপাতা গাছ 

উপসংহার

রামবুটান গাছ চাষ শুধুমাত্র লাভজনক নয় এটি কৃষি অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এই গাছের চাষ অত্যন্ত উপযোগী। রামবুটানের স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং এর উচ্চ বাজার মূল্য কৃষকদের এটি চাষে আগ্রহী করে তুলেছে।

নতুন চাষিদের জন্য পরামর্শ হলো সঠিক প্রজাতির চারা নির্বাচন, পর্যাপ্ত পরিচর্যা এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন থাকা। রামবুটান চাষে সাফল্যের জন্য ধৈর্য এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করাই মূল চাবিকাঠি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *