পৃথিবীতে কত প্রকার গাছ আছে | গাছপালার বৈচিত্র্য ও গুরুত্ব

পৃথিবীতে কত প্রকার গাছ আছে

গাছ হলো আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। পৃথিবীতে বসবাসরত সমস্ত জীবের জন্য গাছপালা সরবরাহ করে খাদ্য, অক্সিজেন, আশ্রয় এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য। তবে পৃথিবীতে কত প্রকার গাছ আছে এবং তাদের বৈচিত্র্য কেমন—এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য গভীর গবেষণা করা হয়েছে এমন তথ্য প্রয়োজন। এই আর্টিকেলে আমরা গাছপালার প্রকারভেদ, বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস এবং তাদের পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এছাড়াও বাংলাদেশের গাছপালার বৈচিত্র্য এবং তাদের সংরক্ষণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হবে।

গাছ কি? গাছের সংজ্ঞা

গাছ হলো বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ যা সাধারণত মাটির ওপর লম্বাভাবে দাঁড়ায় এবং শক্ত কাণ্ড (স্টেম) ও শাখাপ্রশাখা নিয়ে গঠিত। এটি মূলত সূর্যালোকের মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুত করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন প্রদান করে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাছ উদ্ভিদজগতের Plantae রাজ্যের অন্তর্গত এবং এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—ক্লোরোফিল দ্বারা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করা। উদাহরণ: নারিকেল গাছ, বটগাছ, আমগাছ, ইত্যাদি।

আরো পড়ুনঃ গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক 

পৃথিবীতে গাছের সংখ্যার ধারণা

গবেষণা অনুযায়ী পৃথিবীতে আনুমানিক ৩ ট্রিলিয়ন গাছ রয়েছে। ৩ ট্রিলিয়ন সংখ্যাটি লিখতে হলে এটি হবে: ৩,০০০,০০০,০০০,০০০(তিন লক্ষ কোটি)। বিভিন্ন অঞ্চলে গাছের ঘনত্ব ভিন্ন। যেমন:

  • আমাজনের রেইনফরেস্টে প্রায় ১৬০ বিলিয়ন গাছ রয়েছে।
  • আফ্রিকার সাভানা এবং এশিয়ার বনাঞ্চলে এই সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।
  • ২০১৫ সালে ক্রোথার এট আল-এর গবেষণা প্রকাশিত হয় যেখানে গ্লোবাল ট্রি ডেনসিটি ম্যাপের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক গাছের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

গাছের প্রধান বিভাগ

গাছকে প্রধানত দুইটি বৃহৎ বিভাগে ভাগ করা হয়:

  • জিমনোস্পার্ম (Gymnosperm): এই প্রজাতির গাছের বীজ খোলসবিহীন বা নগ্ন। উদাহরণ: পাইন, সাইপ্রাস।
  • অ্যাঞ্জিওস্পার্ম (Angiosperm): এই প্রজাতির গাছের বীজ ফুলের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত থাকে। উদাহরণ: আমগাছ, জামগাছ।

গাছের শ্রেণিবিন্যাস – শ্রেণিবিন্যাসের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

গাছের শ্রেণিবিন্যাসে সাধারণত ট্যাক্সোনমি ব্যবহৃত হয়। এর প্রধান স্তরগুলো হলো:

  • রাজ্য (Kingdom): উদ্ভিদজগত।
  • পর্ব (Phylum): উদাহরণস্বরূপ, Magnoliophyta
  • পরিবার (Family): উদাহরণ: আমগাছের পরিবার Anacardiaceae
  • গণ (Genus): উদাহরণ: ম্যাঙ্গো।
  • প্রজাতি (Species): উদাহরণ: Mangifera indica

এই শ্রেণিবিন্যাস আমাদের গাছপালার বৈচিত্র্য এবং তাদের সঠিক সনাক্তকরণে সাহায্য করে।

গাছের প্রকারভেদ – পৃথিবীতে কত প্রকার গাছ আছে

গাছপালার প্রকারভেদ তাদের আকার, বৈশিষ্ট্য, এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করে।

  • স্থলজ গাছপালা (Terrestrial Plants): উদাহরণ: মহীরুহ, তালগাছ।
  • জলজ উদ্ভিদ (Aquatic Plants): উদাহরণ: ম্যানগ্রোভ, ওয়াটার লিলি।
  • ঝোপঝাড় (Shrubs): উদাহরণ: বেলফুল গাছ।
  • লতানো উদ্ভিদ (Climbers): উদাহরণ: কুমড়া, মানি প্ল্যান্ট।

অঞ্চলভিত্তিক গাছের প্রকারভেদ

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে গাছপালার বৈচিত্র্য ভিন্ন।

  • গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনভূমি: বৈশিষ্ট্য: উচ্চ গাছ, গভীর পত্রপল্লব। উদাহরণ: আমাজনের বৃষ্টিচ্ছায়া বন।
  • উপক্রান্তীয় বনভূমি: বৈশিষ্ট্য: খরাপ্রবণ এলাকায় খাপ খাইয়ে নেওয়া গাছ। উদাহরণ: কাঁকড়া গাছ।
  • উত্তরাঞ্চলীয় তুন্দ্রা: বৈশিষ্ট্য: ক্ষুদ্রাকৃতির গাছ। উদাহরণ: বার্চ, উইলো।

গাছের পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ভূমিকা

গাছের পরিবেশগত ভূমিকা

গাছ শুধু অক্সিজেন সরবরাহ করে না এটি পরিবেশের বিভিন্ন দিকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ: গাছের পাতাগুলো সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।
  • মাটি সংরক্ষণ: গাছের শিকড় মাটিকে শক্ত করে এবং ভূমিধস প্রতিরোধ করে।
  • বায়ুর গুণগত মান উন্নয়ন: ধূলিকণা এবং বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে বায়ুকে বিশুদ্ধ রাখে।

গাছের অর্থনৈতিক ভূমিকা

গাছপালা শুধু পরিবেশ রক্ষা করে না এটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • কাঠ এবং আসবাবপত্র: উদাহরণ: সেগুন কাঠ, গর্জন কাঠ।
  • ফল এবং ফসল: উদাহরণ: আম, কাঁঠাল।
  • ঔষধি গাছ: উদাহরণ: নিম, তুলসী।
  • প্রাকৃতিক সম্পদ: রাবার এবং কাগজের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে গাছপালার বৈচিত্র্য – বাংলাদেশের স্থানীয় গাছপালা

বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির গাছ রয়েছে।

  • ফলগাছ: আম, জাম, কাঁঠাল।
  • বনজ গাছ: সুন্দরবনের গর্জন, সেগুন।
  • ঔষধি গাছ: অর্জুন, বাসক।

বাংলাদেশের কিছু গাছ প্রজাতি এখন বিলুপ্তির পথে এর কারণ হলো বন উজাড়, পরিবেশ দূষণ। উদাহরণ: চন্দনগাছ, রক্তচন্দন।

পৃথিবীতে কত প্রকার গাছ

গাছ সংরক্ষণের উপায়

গাছ সংরক্ষণ আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বর্তমান সময়ে বন উজাড়, নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের কারণে গাছের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি কার্যকর উপায় হলো:

প্রথমত সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। গ্রামীণ ও নগর এলাকায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে তারা নিজেদের প্রয়োজনে গাছ রোপণ করেন এবং রক্ষার দায়িত্ব নেন। দ্বিতীয়ত বন উজাড় প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। যেসব অঞ্চলে বেআইনি ভাবে বন উজাড় করা হচ্ছে সেখানে নজরদারি বৃদ্ধি করা উচিত।

আরো পড়ুনঃ গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়

তৃতীয়ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। এছাড়া গাছ সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে হবে।

টেকসই ব্যবস্থাপনা ও ভবিষ্যৎ

জলবায়ু পরিবর্তন আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই সংকট মোকাবিলায় টেকসই বন ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমে পরিবেশ-বান্ধব কৃষি এবং বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গাছপালা রক্ষা করা যায়। এটি শুধু গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করে না বরং বনাঞ্চল সংরক্ষণেও সাহায্য করে।

দ্বিতীয়ত গ্রিন টেকনোলজির ব্যবহার করে কাঠ ও অন্যান্য বনজ পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ কাঠের বিকল্প হিসেবে বাম্বু বা বাঁশের ব্যবহার সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশকে একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি করতে হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (SDG) পূরণে বন সংরক্ষণ একটি আবশ্যকীয় শর্ত।

উপসংহার – পৃথিবীতে কত প্রকার গাছ আছে

গাছপালা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে না বরং আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক কল্যাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে পরিবেশ দূষণ, বন উজাড় এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে আজ আমাদের গাছপালা মারাত্মক হুমকির মুখে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিরোধে গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন আমাদের শুধু প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ নয় বরং বিশ্ববাসীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাই আমাদের উচিত গাছপালা রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।

আপনারা যারা পরিবেশপ্রেমী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ পৃথিবী রেখে যেতে চান তাদের এখন থেকেই গাছ লাগানো এবং সংরক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এই আর্টিকেল পড়ার পর আপনি যদি গাছ রোপণ করতে উদ্বুদ্ধ হন তবে সেটি হবে আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *