পাইলস, বাংলায় যাকে আমরা অর্শ বা গাঁট বলা হয়ে থাকে, এটি একটি সাধারণ অথচ অত্যন্ত অস্বস্তিকর রোগ। বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী এই রোগে ভুগে থাকেন। এর প্রধান লক্ষণ হলো মলদ্বার অঞ্চলে ফোলা, ব্যথা, কখনো রক্তপাতসহ মলত্যাগে জ্বালা। অনেকেই এই রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবনে অসুবিধায় পড়েন এবং বিব্রতবোধ করেন। বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে সংকোচ বোধ করায় তারা ঘরোয়া চিকিৎসা বা ভেষজ সমাধানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ কারণে “পাইলসের ঔষধি গাছ” সম্পর্কিত অনুসন্ধান প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
প্রাকৃতিক চিকিৎসার প্রতি মানুষের এই আস্থা নতুন কিছু নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা নানা গাছপালা ও ঔষধি পাতার মাধ্যমে পাইলসের মতো রোগের উপশম করে আসছেন। এই গাছগুলোর প্রাকৃতিক উপাদান যেমন অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার মতো বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা পাইলসের মূল কারণগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে।
আর পড়ুন: লরেল গাছ
এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো—পাইলস কেন হয়, কীভাবে এটি আমাদের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে এবং কোন কোন গাছ ও পাতার সাহায্যে প্রাকৃতিকভাবে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আপনার জন্য উপস্থাপন করা হবে ফলপ্রসূ গাছের তালিকা, ব্যবহারের নিয়ম, গবেষণাভিত্তিক তথ্য এবং বাস্তব উদাহরণ।
পাইলস কী, কেন হয় এবং কীভাবে প্রভাব ফেলে
পাইলস বা অর্শ একটি ভাস্কুলার রোগ যা মূলত মলদ্বারের আশপাশের শিরাগুলো ফুলে গেলে বা স্ফীত হয়ে উঠলে ঘটে। এই রোগকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়—ইন্টারনাল পাইলস (অভ্যন্তরীণ) এবং এক্সটারনাল পাইলস (বহিঃস্থ)। অভ্যন্তরীণ পাইলস সাধারণত তেমন ব্যথা তৈরি না করলেও রক্তপাত ঘটাতে পারে। আর এক্সটারনাল পাইলস সাধারণত বেশ বেদনাদায়ক এবং ফোলা অংশটি বাইরে থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
এই রোগের মূল কারণসমূহ হলো:
-
দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য বা দীর্ঘ সময় ধরে টয়লেটে বসে থাকা
-
কম আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া
-
শরীরচর্চার অভাব
-
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত চাপ
-
বারবার ডায়রিয়া
পাইলসের প্রাথমিক উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে—
-
মলত্যাগের সময় ব্যথা ও অস্বস্তি
-
মলদ্বার থেকে রক্তপাত
-
ফোলা অংশে চুলকানি বা জ্বালা
-
একসময় ব্যথা এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যে বসে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে
এই রোগ মানসিক চাপও সৃষ্টি করে, বিশেষ করে যখন এটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ ধারণ করে। এ জন্যই প্রাথমিক পর্যায়ে কার্যকর সমাধান গ্রহণ করা জরুরি। অথচ অনেকেই অপারেশন বা আধুনিক চিকিৎসার পরিবর্তে প্রাকৃতিক ও ভেষজ চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী হন।
কেন ভেষজ গাছ পাইলসের প্রাকৃতিক চিকিৎসায় কার্যকর
পাইলসের মতো দীর্ঘমেয়াদী ও অস্বস্তিকর রোগে যখন ঔষধি গাছের কথা আসে, তখন তা শুধু প্রাকৃতিক বিকল্প নয়—বরং একটি শতভাগ কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বহু যুগ ধরেই ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে পাইলসের চিকিৎসা চলে আসছে। এতে যেমন শরীরের ওপর কম চাপ পড়ে, তেমনি কমে আসে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি।
প্রাকৃতিক ঔষধি গাছের কার্যকারিতা মূলত তিনটি দিকে লক্ষ্য করা যায়:
- প্রদাহ ও ব্যথা হ্রাস: যেমন নিশিন্দা, তুলসী বা অশ্বগন্ধা—এই গাছগুলোর উপাদান শরীরের স্ফীত শিরা ও প্রদাহ কমাতে ভূমিকা রাখে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসন: কলমিশাক, পাটিশাক ও থানকুনি পাতায় থাকা আঁশ ও মিউকিলেজ উপাদান পায়খানা নরম করে, যা পাইলসের মূল ট্রিগার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- রক্তপাত রোধ: অশ্বগন্ধা ও বাবলা ছালের নির্যাসে রয়েছে এমন উপাদান যা মলদ্বার অঞ্চলের ক্ষত শুকাতে সাহায্য করে এবং রক্তপাত কমায়।
ভেষজ চিকিৎসার আরেকটি বড় সুবিধা হলো, এগুলো দৈনন্দিন খাবারের সাথেও সহজে মিলিয়ে নেওয়া যায়। যেমন পাটিশাক বা কলমিশাক রান্না করে খাওয়াও যেতে পারে। তুলসী পাতা চায়ে ব্যবহার করলে তা শুধু পাইলস নয়, বরং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
অধিকন্তু, ইউনানি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে বহু প্রাচীনকাল থেকেই পাইলসের জন্য এসব গাছের ব্যবহার চলে আসছে। তাই আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে প্রাকৃতিক পন্থার একটি ভারসাম্য গঠন করাই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় পাইলসের ঔষধি গাছ সমূহ
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটিতে অনেক ভেষজ গাছ জন্মায় যা পাইলসসহ নানা রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। নিচে আলোচনা করা হলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর গাছ, যেগুলোর পাতা, ছাল বা শিকড় ব্যবহার করে পাইলসের উপশম পাওয়া যায়।
নিশিন্দা গাছ (Vitex negundo)
নিশিন্দা গাছ বাংলাদেশে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। এর পাতায় রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা শরীরের প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে বিশেষভাবে সহায়ক। সাধারণত শুকনো পাতা গুঁড়ো করে সকালে খালি পেটে খাওয়া হয়, অথবা গরম পানিতে ফুটিয়ে চা বানিয়েও পান করা যায়।
গ্রামবাংলায় অনেক সময় নিশিন্দা পাতার প্রলেপ তৈরি করে বাহ্যিকভাবে মলদ্বারে ব্যবহার করা হয়। এতে চুলকানি ও ফোলাভাব কমে।
তুলসী গাছ (Ocimum tenuiflorum)
তুলসীকে বলা হয় “ঔষধি রাজা”। এই গাছের পাতায় অ্যান্টি-সেপ্টিক ও প্রদাহনাশক উপাদান রয়েছে। তুলসী পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে মলদ্বার শুষ্ক থাকে এবং ক্ষত দ্রুত শুকায়। তুলসী চা নিয়মিত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমে যায়, যা পাইলস নিরাময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
অশ্বগন্ধা (Withania somnifera)
পাইলসের অভ্যন্তরীণ রক্তপাত বন্ধে অশ্বগন্ধা একটি পরিচিত নাম। এটি শরীরের শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, একইসাথে অন্তর্নিহিত শিরার ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধা মূল সাধারণত গুঁড়ো করে খাওয়া হয় দুধ বা মধুর সাথে।
বাবলা গাছের ছাল (Vachellia nilotica)
বাবলার ছালে রয়েছে ট্যানিন জাতীয় উপাদান যা রক্তপাত বন্ধ করতে সাহায্য করে। ছালের নির্যাস পান করা বা স্নানজলে মিশিয়ে ব্যবহারে বাহ্যিক পাইলসের ক্ষেত্রে দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
অরেঞ্জ জেসমিন (Murraya paniculata)
বাংলাদেশে কামিনী গাছ নামে পরিচিত এই গাছের পাতা ও বীজে রয়েছে হালকা বিষাক্ততা নিরসনের উপাদান। পাইলসজনিত ক্ষত শুকাতে কামিনী পাতার রস ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোন গাছের পাতা খেলে পাইলস ভালো হয়? বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণভিত্তিক আলোচনা
বাংলাদেশে “কোন গাছের পাতা খেলে পাইলস ভালো হয়”—এই প্রশ্নটি প্রায় প্রতিটি পরিবারেই শোনা যায়, বিশেষ করে যখন কেউ দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে বা অর্শ রোগে আক্রান্ত হন। ভেষজ গাছের পাতার কার্যকারিতা বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত, তবে এখন তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রমাণিত।
তুলসী পাতার রস:
তুলসী গাছের (Ocimum sanctum) পাতা শরীরের প্রদাহ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ৫–৭টি কচি তুলসী পাতা চিবিয়ে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং অভ্যন্তরীণ পাইলসের সংক্রমণও ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। তুলসী পাতা রক্ত পরিশোধক হিসেবেও কাজ করে, যা মলদ্বার থেকে রক্তপাত বন্ধে সহায়ক।
নিশিন্দা পাতা:
Vitex negundo গাছের পাতা উষ্ণপ্রভাব সম্পন্ন। এই পাতা সিদ্ধ করে তার পানি দিয়ে স্নান করলে বাহ্যিক পাইলসের ফোলাভাব ও জ্বালা কমে। একইসঙ্গে কচি পাতার রস দিনে দুইবার খেলে পাইলসের ব্যথা ও রক্তপাত হ্রাস পায়।
থানকুনি পাতা:
Centella asiatica বা থানকুনি পাতার রস অন্ত্রের প্রদাহ কমাতে ভূমিকা রাখে। এটি ক্ষত নিরাময় করে, পাইলসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিরা ও চামড়ায় আরাম দেয়।
কলমিশাক:
যদিও এটি সম্পূর্ণরূপে একটি গাছের শাক, তবে এর পাতা কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসনে আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকর। কলমিশাক প্রতিদিন রান্না করে খাওয়ালে মলদ্বার নরম থাকে, ফলে পাইলসের ব্যথা ও রক্তপাত কমে।
পাটিশাক:
পাইলসের ক্ষেত্রে পাটিশাকের পাতা দারুণভাবে উপকারী। এই পাতায় রয়েছে পর্যাপ্ত আঁশ ও আয়রন যা অন্ত্রের কার্যক্ষমতা ঠিক রাখে। নিয়মিত খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে পাইলসের তীব্রতা অনেকটাই কমে যায়।
এই পাতা বা গাছগুলো শুধুমাত্র উপসর্গ উপশম করে না, বরং ধীরে ধীরে মূল সমস্যার প্রতিকার ঘটায়। তবে অবশ্যই নিয়মিত এবং পরিমাণমতো গ্রহণ করতে হবে, অতিরিক্ত গ্রহণে হিতে বিপরীত হতে পারে।
পাইলসের ঔষধি গাছ – ঘরোয়া চিকিৎসা ও ব্যবহারবিধি
অনেকেই প্রশ্ন করেন—পাইলসের গাছ কিভাবে ব্যবহার করবো? ঘরোয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক গাছ নির্বাচন এবং এর ব্যবহার পদ্ধতি জানা।
পাতার রস গ্রহণ:
অনেক ভেষজ গাছের পাতা কাঁচা চিবানো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে পাতাগুলো ধুয়ে রস বের করে তা সকালে খালি পেটে পান করা যেতে পারে। যেমন—তুলসী, নিশিন্দা, থানকুনি, পাটিশাকের পাতা।
- পেস্ট বা প্রলেপ তৈরি:
- বাহ্যিক পাইলসের ক্ষেত্রে নিশিন্দা বা কামিনীর পাতা বেটে প্রলেপ তৈরি করে মলদ্বারে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় প্রদাহ হ্রাস পায় এবং আরাম মেলে।
- পাতার চা বা ক্বাথ:
- তুলসী, অশ্বগন্ধা, বাবলা ছাল—এইসব গাছের অংশ গরম পানিতে ফুটিয়ে তার চা তৈরি করে খাওয়া যায়। এটি দেহের অভ্যন্তরীণ জ্বালা প্রশমন করে।
- স্নানজলে ব্যবহার:
- বাবলার ছাল অথবা নিশিন্দা পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে স্নান করলে বাহ্যিক ক্ষত ও জ্বালা কমে যায়। এটি গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও বহুল প্রচলিত পদ্ধতি।
- খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত:
- পাটিশাক, কলমিশাক, বেলপাতা ইত্যাদি রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে। নিয়মিত এসব পাতা খাওয়ালে দীর্ঘমেয়াদী উপকার পাওয়া যায়।
তবে ঘরোয়া চিকিৎসা গ্রহণের আগে রোগের ধরণ বুঝে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—যদি রক্তপাত বেশি হয় বা ব্যথা অসহনীয় হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়েই ঘরোয়া চিকিৎসা গ্রহণ বিপজ্জনক হতে পারে।
আর পড়ুন: গেওয়া গাছ
পাইলসের ঔষধি গাছ -সতর্কতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যদিও ভেষজ গাছ প্রাকৃতিক এবং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, তারপরও যেকোনো প্রাকৃতিক চিকিৎসা গ্রহণের আগে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কারণ সব গাছ সবার শরীরের জন্য উপযোগী নাও হতে পারে।
অতিরিক্ত সেবন বিপজ্জনক:
নিশিন্দা বা অশ্বগন্ধার মতো গাছে স্ট্রং ফার্মাকোলজিক্যাল উপাদান থাকে। অতিরিক্ত গ্রহণে লিভার বা পাকস্থলীতে সমস্যা হতে পারে।
গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য উপযুক্ত নয়:
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য তুলসী, অশ্বগন্ধা ইত্যাদি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। একইভাবে শিশুদের ক্ষেত্রে ভেষজ চিকিৎসা শুধুমাত্র চিকিৎসকের অনুমতিতে নেওয়া উচিত।
বাহ্যিক ব্যবহারে সংবেদনশীলতা:
কোনো কোনো গাছের পাতা বা রস চামড়ায় প্রয়োগ করলে অ্যালার্জি বা চুলকানি হতে পারে। আগে হাতে একটু ব্যবহার করে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
সময় ও ধৈর্য:
ভেষজ চিকিৎসা তাৎক্ষণিক ফল দেয় না। এটি ধীরে ধীরে কাজ করে। ফলে ধৈর্য ধরে ২–৩ সপ্তাহ পর্যন্ত নিয়মিত ব্যবহার অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
মানসম্পন্ন উৎস:
অনেক সময় রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া শুকনো পাতায় জীবাণু বা দূষণ থাকতে পারে। ভেষজ গাছ নিজে লাগিয়ে সংগ্রহ করা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর।
পাইলস প্রতিরোধে ভেষজ গাছের পাশাপাশি জীবনধারাগত পরিবর্তন
ভেষজ গাছের ব্যবহার কেবল উপসর্গ কমায় না, এটি আমাদের জীবনধারার অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রকৃত সমাধান পেতে চাইলে শুধু গাছ নির্ভর না থেকে জীবনযাপনেও কিছু পরিবর্তন আনা দরকার।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান:
পানি অভ্যন্তরীণ পরিস্রাবণ বজায় রাখে এবং অন্ত্র নরম রাখে। পাইলস প্রতিরোধে এটি এক নম্বর শর্ত।
আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া:
ডাল, শাকসবজি, ব্রাউন রাইস, ফল—এসব খাবারে প্রচুর ফাইবার থাকে। যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং সহজে মলত্যাগে সহায়তা করে।
নিয়মিত ব্যায়াম:
দিনে অন্তত ৩০ মিনিট হেঁটে চললে অন্ত্রের গতি বৃদ্ধি পায়। যেসব মানুষ দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন, তাদের এই অভ্যাসটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
টয়লেটের অভ্যাস পরিবর্তন:
দীর্ঘ সময় টয়লেটে বসে থাকা, মোবাইল ব্যবহার করা, বা জোর করে মলত্যাগের চেষ্টা—এসব বদভ্যাস ত্যাগ করা উচিত।
মানসিক চাপ হ্রাস:
মানসিক চাপের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়ে, যা পরোক্ষভাবে পাইলসকে বাড়িয়ে তোলে। ধ্যান, যোগব্যায়াম, বা হালকা গান শোনা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
জীবনধারার এই পরিবর্তনগুলো ভেষজ চিকিৎসার সাথে সমন্বয় করলে পাইলসের প্রতিকারে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই ফল পাওয়া সম্ভব।
ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা ও কেস স্টাডি
পাইলস একটি এমন রোগ যা নিয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে আলোচনা করতে চান না। তবে যারা প্রকৃত ভেষজ চিকিৎসা গ্রহণ করে উপকার পেয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের জন্য দিকনির্দেশনামূলক হতে পারে। নিচে তিনজন বাস্তব ব্যবহারকারীর সংক্ষিপ্ত কাহিনি তুলে ধরা হলো:
অভিজ্ঞতা ১: তুলসী পাতা চিবিয়ে মুক্তি পেয়েছেন রুবেল (৩২), কুষ্টিয়া
“আমি প্রায় ছয় মাস ধরে বাহ্যিক পাইলসে ভুগছিলাম। ব্যথা, রক্তপাত—সব মিলিয়ে জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। একজন স্থানীয় কবিরাজ তুলসী পাতা প্রতিদিন খালি পেটে চিবিয়ে খেতে বলেন। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে আমি অনেক আরাম অনুভব করি। এখন নিয়মিত তুলসী চা খাই।”
অভিজ্ঞতা ২: নিশিন্দা পাতার স্নানে উপকার পেলেন হাজেরা বেগম (৪৫), বরিশাল
“আমার বাহ্যিক পাইলস ছিল দীর্ঘদিন। নিশিন্দা পাতা সিদ্ধ করে সেই পানিতে প্রতিদিন বসে থাকা শুরু করি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফোলাভাব কমে আসে। এখন ঘরে একটি নিশিন্দা গাছ লাগিয়েছি।”
অভিজ্ঞতা ৩: অশ্বগন্ধা খেয়ে রক্তপাত বন্ধ করেছেন শরিফুল (২৮), রাজশাহী
“পাইলসের কারণে প্রায় প্রতিদিন রক্ত পড়ত। অশ্বগন্ধা গুঁড়ো করে সকালে ও রাতে খাওয়া শুরু করি। চিকিৎসকের অনুমতিতে এটি চালিয়ে যাই। প্রায় এক মাস পরে রক্তপাত বন্ধ হয়।”
এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকেই বোঝা যায়, নিয়মিত ও পরিমিতভাবে সঠিক গাছের ব্যবহার করলে পাইলস থেকে উপশম পাওয়া সম্ভব।
চিকিৎসকের মতামত ও গবেষণাভিত্তিক তথ্য
প্রতিটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির পেছনে যদি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকে, তাহলে তা আরও বেশি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। চলুন দেখে নিই কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা এবং কী পাওয়া যাচ্ছে আধুনিক গবেষণায়:
ইউনানি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ব্যাখ্যা:
প্রাচীন আয়ুর্বেদ গ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’তে পাইলস (Arsha) নিরাময়ে নিশিন্দা, অর্জুন ছাল, হরীতকী প্রভৃতির উল্লেখ রয়েছে। ইউনানি চিকিৎসায়ও ‘আসারে শেফা’ ও ‘ইলাজুল আমরাস’ বইতে তুলসী ও থানকুনির ব্যবহার বর্ণনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা:
২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তুলসী পাতার নির্যাসে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান রয়েছে যা পাইলসের প্রদাহ দূর করতে সক্ষম। একই গবেষণায় নিশিন্দা পাতাকে অ্যান্টি-হেমোরয়েডাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
South Asian Journal of Medicinal Plants অনুযায়ী:
থানকুনি পাতায় থাকা ট্রাইটারপিনস ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান রক্তনালীর প্রদাহ কমিয়ে পাইলসের লক্ষণ কমায়।
চিকিৎসকের পরামর্শ:
ঢাকার এক অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ডা. শামীমা সুলতানা বলেন—“সব পাইলসের জন্য একই গাছ উপযুক্ত নয়। রোগীর বয়স, ধরণ ও শারীরিক অবস্থা বুঝে গাছের ব্যবহার ঠিক করতে হয়।”
এসব মতামত ও গবেষণা প্রমাণ করে, পাইলসের ভেষজ চিকিৎসা কেবল লোকজ বিশ্বাস নয়, বরং চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত একটি কার্যকর পন্থা।
আর পড়ুন: পিস লিলি গাছ
উপসংহার – পাইলসের ঔষধি গাছ
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাইলস একটি সাধারণ অথচ উপেক্ষিত স্বাস্থ্য সমস্যা। আধুনিক চিকিৎসা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি অনেকের জন্য বিব্রতকরও বটে। তাই প্রাকৃতিক চিকিৎসা, বিশেষ করে পাইলসের ঔষধি গাছ ব্যবহার, দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
তুলসী, নিশিন্দা, অশ্বগন্ধা, পাটিশাক, থানকুনি, কলমিশাকসহ অনেক গাছের পাতা ও মূল ব্যবহার করে প্রাকৃতিকভাবে পাইলস নিরাময় সম্ভব। তবে অবশ্যই নিয়ম মেনে এবং ধৈর্য ধরে ব্যবহার করতে হবে। সাথে অবশ্যই জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে, যেমন—পানি পান, ব্যায়াম, আঁশযুক্ত খাবার ইত্যাদি।
ভেষজ গাছ শুধু একটি নিরাময়ের উপায় নয়, বরং আমাদের পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এগুলো রক্ষা ও চাষে আগ্রহী হওয়া আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও উপকার বয়ে আনবে।