তুলসী গাছ প্রকৃতির একটি অসাধারণ দান যা বহু বছর ধরে মানবসভ্যতার উপকারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তুলসী গাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এই উদ্ভিদটি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর বৈশিষ্ট্যের জন্য নয় বরং ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক কারণে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। তুলসী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum যা স্থানীয়ভাবে ‘হলি বেসিল’ নামেও পরিচিত।
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় তুলসী গাছ প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনে দেখা যায়। এটি সহজে জন্মে এবং বিশেষ যত্ন ছাড়াই বৃদ্ধি পায়। তুলসী গাছের পাতা, শিকড় এবং বীজ ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়। এতে থাকা বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান শ্বাসকষ্ট, সর্দি এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। শুধু তাই নয় এর আধ্যাত্মিক দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে তুলসী গাছ পবিত্র মনে করা হয়।
তুলসী গাছের গুরুত্ব বুঝতে হলে এর বহুবিধ ব্যবহার এবং মানবজীবনে প্রভাব সম্পর্কে জানা জরুরি। এই আর্টিকেলে আমরা তুলসী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম থেকে শুরু করে এর বিভিন্ন প্রকারভেদ, উপকারিতা এবং ব্যবহারিক দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আর পড়ুন: নয়নতারা ফুল গাছের পরিচর্যা
তুলসী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম এবং উদ্ভিদতত্ত্ব
তুলসী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum যা ল্যামিয়াসি (Lamiaceae) পরিবারভুক্ত। তুলসী গাছ মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে। এটি সাধারণত ৩০-৬০ সেন্টিমিটার লম্বা হয় এবং এর পাতা গাঢ় সবুজ বা বেগুনি রঙের হতে পারে। তুলসী গাছের ফুল ছোট এবং সাদা বা গোলাপি বর্ণের হয়।
তুলসী গাছের উৎপত্তি মূলত ভারত উপমহাদেশে তবে এখন এটি সারা পৃথিবীতেই চাষ করা হয়। এটি একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ এবং শীতপ্রধান এলাকাতেও জন্মানোর সক্ষমতা রাখে। তুলসী গাছের পাতা এবং শিকড়ে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলসী গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এতে উপস্থিত অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান। তুলসীর পাতায় ইউজেনল নামে একটি প্রধান উপাদান থাকে যা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-সেপ্টিক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও তুলসীতে থাকা ভিটামিন এ, সি এবং ক্যালসিয়াম মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
তুলসী গাছের বিভিন্ন প্রকারভেদ
তুলসী গাছের কয়েকটি জনপ্রিয় প্রকারভেদ রয়েছে যা তাদের রং, স্বাদ এবং ভেষজ গুণের ভিত্তিতে আলাদা হয়। প্রতিটি প্রকারভেদ বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা বহন করে। নিচে এর প্রধান প্রকারভেদগুলোর আলোচনা করা হলো:
- রাম তুলসী (Green Tulsi): রাম তুলসী হলো সবচেয়ে সাধারণ প্রকারভেদ যা হালকা সবুজ রঙের পাতা এবং মিষ্টি সুগন্ধের জন্য পরিচিত। এটি মূলত সর্দি-কাশি এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও রাম তুলসী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- শ্যাম তুলসী (Purple Tulsi: শ্যাম তুলসীর পাতা গাঢ় বেগুনি রঙের হয়। এটি মূলত উচ্চ তীব্রতার সুগন্ধ এবং স্বাদযুক্ত। শ্যাম তুলসী মানসিক চাপ কমাতে এবং স্নায়ু শিথিল করতে বিশেষভাবে কার্যকর।
- বন তুলসী: বন তুলসী একটি বুনো জাতের তুলসী যা মূলত গ্রামীণ এলাকায় বেশি দেখা যায়। এই তুলসী আকারে ছোট এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণে সমৃদ্ধ। এটি চর্মরোগ এবং ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
- ভৃঙ্গরাজ তুলসী: ভৃঙ্গরাজ তুলসী তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত তবে এর উপকারিতা অনস্বীকার্য। এটি চুল পড়া রোধ করতে এবং চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়।
তুলসীর এই প্রকারভেদগুলো তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহারিক প্রয়োগে আলাদা হলেও প্রতিটি উদ্ভিদ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
তুলসী গাছের প্রধান উপকারিতা
তুলসী গাছ প্রকৃতির এক অমূল্য দান যা মানবদেহের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কার্যকর। প্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় তুলসী ব্যবহার হয়ে আসছে। তুলসীর প্রধান উপকারিতা নিচে বিশদভাবে উল্লেখ করা হলো:
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: তুলসী গাছের পাতায় উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইটো-কেমিক্যাল উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বিশেষ করে ঠান্ডা, সর্দি-কাশি এবং ভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধে এটি অত্যন্ত কার্যকর।
- শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা দূরীকরণ: তুলসী গাছের পাতা শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন হাঁপানি এবং ব্রংকাইটিসের জন্য উপকারী। এটি ফুসফুস পরিষ্কার করে এবং শ্বাস নিতে সহায়তা করে।
- মানসিক চাপ কমানো: তুলসীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো এটি মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমায়। তুলসীর চা সেবনে স্নায়ু শিথিল হয় এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
- চর্মরোগ নিরাময়: তুলসীর পাতা এবং শিকড়ে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান চর্মরোগ নিরাময়ে সহায়ক। এটি ব্রণ এবং ত্বকের প্রদাহ দূর করতে কার্যকর।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: তুলসীর পাতা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে তুলসীর পাতা চিবিয়ে খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে।
তুলসী গাছ লাগানোর নিয়ম
তুলসী গাছ লাগানো খুবই সহজ এবং এটি বাড়ির উঠোন, বারান্দা, কিংবা টবে অনায়াসেই চাষ করা যায়। সঠিক নিয়ম অনুসরণ করলে এই উদ্ভিদটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে উপকার প্রদান করে। তুলসী গাছ লাগানোর জন্য নিচের ধাপে ধাপে নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
- উপযুক্ত সময় এবং স্থান নির্বাচন: তুলসী গাছের বৃদ্ধি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় সবচেয়ে ভালো হয়। বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস গাছ লাগানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই গাছটি পূর্ণ সূর্যালোক পছন্দ করে তাই এমন স্থান নির্বাচন করা উচিত যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পৌঁছায়।
- মাটি নির্বাচন: তুলসী গাছের জন্য হালকা দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। মাটিতে পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা থাকতে হবে কারণ জমে থাকা পানি গাছের শিকড় পচিয়ে ফেলতে পারে। মাটির পিএইচ (pH) মাত্রা ৬-৭.৫-এর মধ্যে হলে গাছ ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়।
- চারা বা বীজ থেকে চাষ: তুলসী গাছ বীজ থেকে বা চারা থেকে লাগানো যায়। বীজ থেকে চাষ করার জন্য ১-২ সেন্টিমিটার গভীরতায় বীজ পুঁতে দিন এবং হালকা পানি দিন। চারা ব্যবহার করলে সেটিকে সাবধানে মাটিতে বসিয়ে চারপাশে মাটি ভালোভাবে চেপে দিন।
- পানি ও সার ব্যবস্থাপনা: তুলসী গাছ নিয়মিত পানি পছন্দ করে তবে অতিরিক্ত পানি এড়িয়ে চলা উচিত। শুকনো মৌসুমে প্রতিদিন এবং বর্ষার সময় প্রয়োজনে পানি দিতে হবে। অর্গানিক সার বা কম্পোস্ট প্রতি ১৫-২০ দিন পর পর প্রয়োগ করলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
- নিয়মিত পরিচর্যা: তুলসী গাছের আশেপাশে আগাছা পরিষ্কার রাখা জরুরি। গাছটি স্বাস্থ্যবান রাখতে প্রতি মাসে একবার ডাল ছাঁটাই করা উচিত। এতে নতুন শাখা তৈরি হয় এবং গাছের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
আর পড়ুন: বাংলাদেশে শীতকালীন ফুল গাছ
তুলসী গাছের ধর্মীয় ব্যবহার এবং আচার-অনুষ্ঠানে ভূমিকা
তুলসী গাছ শুধু স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য নয় ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক কারণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে তুলসী গাছ পবিত্র এবং দেবতারূপে পূজিত হয়। এটি বহু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত এবং বিশ্বাস করা হয় যে তুলসীর উপস্থিতি জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আনে।
- তুলসীর ধর্মীয় গুরুত্ব: হিন্দু ধর্মে তুলসী গাছকে দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তুলসী পূজার মাধ্যমে পরিবারের কল্যাণ এবং দারিদ্র্য দূর করার প্রার্থনা করা হয়। তুলসী গাছের নিচে প্রদীপ জ্বালানো একটি সাধারণ ধর্মীয় প্রথা যা পবিত্রতা ও সুখের প্রতীক।
- তুলসী এবং আয়ুর্বেদিক আচার: তুলসী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ধূপ এবং প্রসাধনী তৈরিতেও তুলসী ব্যবহৃত হয়। হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে তুলসী গাছের ঔষধি গুণাবলির ব্যাপক বর্ণনা রয়েছে।
- আধ্যাত্মিক দিক: তুলসী গাছের চারপাশে একটি পবিত্র পরিবেশ তৈরি হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। এটি নেতিবাচক শক্তি দূর করে এবং বাড়িতে ইতিবাচক শক্তি আনতে সাহায্য করে। এই কারণেই তুলসী গাছকে বাড়ির মূল প্রবেশদ্বারে লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
দৈনন্দিন জীবনে তুলসী গাছের ব্যবহার
তুলসী গাছের পাতা, শিকড় এবং বীজ বহুবিধ উপকারে ব্যবহার করা হয়। এটি ঘরোয়া প্রতিষেধক, খাবার এবং প্রসাধনীতে সমানভাবে কার্যকর।
- ঔষধি ব্যবহার: তুলসীর পাতার রস সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, এবং ভাইরাসজনিত জ্বরের জন্য প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সকালে খালি পেটে তুলসী পাতা চিবিয়ে খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
- রান্নায় ব্যবহার: তুলসীর তাজা পাতা এবং শুকনো গুঁড়ো রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এটি খাবারে স্বাদ বাড়ায় এবং পুষ্টিগুণ যোগ করে। তুলসীর পাতা দিয়ে তৈরি চা ঠান্ডা লাগা এবং গলার ব্যথা কমাতে খুবই কার্যকর।
- প্রসাধনী এবং ত্বকের যত্নে ব্যবহার: তুলসী গাছের নির্যাস দিয়ে তৈরি প্রসাধনী পণ্য ত্বক উজ্জ্বল করে এবং ব্রণের সমস্যা দূর করে। তুলসী পাতা বেটে তৈরি প্যাক ত্বকের কালচে ভাব কমাতে সহায়ক।
- পরিবেশগত উপকারিতা: তুলসী গাছ বায়ু থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে এবং পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে। এটি বাড়ির আশেপাশের মশা তাড়াতেও সহায়ক।
তুলসী গাছ কীভাবে সংরক্ষণ করবেন
তুলসী গাছের দীর্ঘমেয়াদী উপকার পেতে সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এতে শুধু গাছটিকে টিকিয়ে রাখা যায় না বরং এর প্রাকৃতিক গুণাগুণও অটুট থাকে।
- শুকনো পাতা সংরক্ষণ: তুলসীর পাতা শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা যায়। এতে পাতাগুলোর গুণাগুণ দীর্ঘদিন ধরে বজায় থাকে এবং যে কোনো সময় এটি চায়ের মতো পানীয়তে ব্যবহার করা যায়।
- বীজ সংরক্ষণ: তুলসীর বীজ শুকিয়ে শীতল এবং শুষ্ক স্থানে রাখলে নতুন গাছ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যায়। এই বীজ কয়েক মাস ধরে কার্যকর থাকে।
- গাছের পরিচর্যা: গাছের শিকড় এবং ডালপালা নিয়মিত ছাঁটাই করলে এটি সুস্থ থাকে এবং দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারযোগ্য হয়। অতিরিক্ত পানি বা রোদ থেকে গাছকে সুরক্ষিত রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।
আর পড়ুন: অশ্বগন্ধা গাছ
তুলসী গাছ শিকড়ের উপকারিতা
তুলসী গাছের শিকড় ভেষজ চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিকড়ের নির্যাস বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানী চিকিৎসায় তুলসী শিকড়ের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এটি প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে শরীরের অভ্যন্তরীণ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর।
- হজমশক্তি উন্নত করে: তুলসীর শিকড়ে থাকা প্রাকৃতিক এনজাইম হজমশক্তি বাড়াতে সহায়ক। এটি খাবার দ্রুত হজম হতে সাহায্য করে এবং গ্যাসের সমস্যা দূর করে।
- কিডনি এবং মূত্রনালীর যত্নে: তুলসীর শিকড়ের রস কিডনি পরিষ্কার রাখতে এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর। আয়ুর্বেদে তুলসীর শিকড় দিয়ে তৈরি পানীয় কিডনির পাথর অপসারণে ব্যবহৃত হয়।
- প্রদাহ কমায়: তুলসীর শিকড়ে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণ রয়েছে, যা শরীরের যে কোনো প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এটি বাতের ব্যথা এবং আর্থ্রাইটিসের মতো সমস্যায় বিশেষভাবে কার্যকর।
- চর্মরোগ নিরাময়ে: তুলসীর শিকড়ের গুঁড়ো বা পেস্ট চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি ত্বকের সংক্রমণ কমায় এবং ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে।
তুলসী গাছের আর্থিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এবং স্থানীয় বাজারে তুলসী গাছের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর চাষ এবং বাণিজ্যিক উৎপাদন স্থানীয় কৃষকদের জন্য আয়ের একটি নতুন উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।
- ওষুধ শিল্পে ব্যবহার: বাংলাদেশে ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করা অনেক প্রতিষ্ঠান তুলসী গাছের উপাদান ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করে। তুলসীর নির্যাস থেকে তৈরি সিরাপ, ক্যাপসুল এবং অয়েল স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
- স্থানীয় চাষীদের জন্য আয়ের উৎস: তুলসী চাষ কম খরচে এবং কম সময়ে ফলন দেয়। এর ফলে স্থানীয় কৃষকরা তুলসী গাছ চাষ করে ভালো মুনাফা অর্জন করতে পারেন।
- রপ্তানির সুযোগ: আন্তর্জাতিক বাজারে তুলসী ভিত্তিক পণ্য যেমন তুলসী তেল, শুকনো পাতা এবং বীজের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ তুলসী চাষ এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
তুলসী গাছের পরিবেশগত ভূমিকা
তুলসী গাছ পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এটি বায়ু পরিশোধন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বায়ু বিশুদ্ধকরণ: তুলসী গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। বাড়ির আশপাশে তুলসী গাছ লাগালে বায়ু দূষণ অনেকাংশে কমানো যায়।
কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ: তুলসী গাছের পাতা এবং শিকড় থেকে নির্গত প্রাকৃতিক গন্ধ মশা এবং অন্যান্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দূরে রাখে। এটি জৈব কীটনাশক হিসেবে কার্যকর।
মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি: তুলসী গাছের শিকড় মাটির পুষ্টি ধরে রাখতে সাহায্য করে। এটি মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং জৈব কৃষিতে ভূমিকা রাখে।
জীববৈচিত্র্যের জন্য আশ্রয়স্থল: তুলসী গাছ অনেক প্রকার পোকামাকড় এবং প্রজাপতির জন্য প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। এটি প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক।
আর পড়ুন: বারোমাসি ফুল গাছ
তুলসী চা – একটি স্বাস্থ্যকর পানীয়
তুলসী চা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ভেষজ চা। এটি স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অত্যন্ত উপকারী এবং সহজে তৈরি করা যায়। তুলসী চায়ের মূল উপাদান তুলসীর তাজা বা শুকনো পাতা।
তুলসী চায়ের উপকারিতা
- মানসিক চাপ কমায়: তুলসী চা স্নায়ু শিথিল করে এবং মানসিক স্বস্তি প্রদান করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: তুলসী চা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: তুলসী চা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
- হজম উন্নত করে: এটি হজমশক্তি বাড়ায় এবং গ্যাস, অম্বল দূর করে।
তুলসী চা তৈরির পদ্ধতি
- এক কাপ পানি গরম করুন।
- এতে ৫-৬টি তাজা বা শুকনো তুলসীর পাতা দিন।
- ৫ মিনিট ঢেকে রেখে দিন।
- ছেঁকে নিয়ে গরম অবস্থায় পান করুন। প্রয়োজনে মধু বা লেবু যোগ করতে পারেন।
উপসংহার – তুলসী গাছ
তুলসী গাছ প্রকৃতির এক অসামান্য দান, যা স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর বহুমুখী ব্যবহার এবং সহজ চাষযোগ্যতার কারণে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। তুলসী গাছ কেবল আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে না এটি পরিবেশ সুরক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে তুলসী গাছের ব্যবহার এবং চাষ আরও বিস্তৃত করতে সরকার এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। তুলসী চাষের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের আর্থিক উন্নতি যেমন সম্ভব তেমনই এর বহুমুখী ব্যবহার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
তুলসী গাছ লাগানো এবং পরিচর্যা করা আমাদের জন্য সহজ আর এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি। তাই প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি তুলসী গাছ থাকা উচিত যা আমাদের জীবনে সুখ, শান্তি এবং সুস্থতা নিয়ে আসবে।