জোজোবা গাছ – চাষ পদ্ধতি, উপকারিতা ও বাংলাদেশে সম্ভাবনা

জোজোবা গাছ

বর্তমান বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। জোজোবা গাছ এমন একটি পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদ, যা সৌন্দর্যচর্চা থেকে শুরু করে শিল্প, কৃষি ও স্বাস্থ্যসেবায় বহুমাত্রিক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে এখনো এটি নতুন একটি নাম হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্য অনেক। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব জোজোবা গাছের গঠন, ব্যবহার, উপকারিতা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর সম্ভাবনা সম্পর্কে।


জোজোবা গাছের পরিচিতি

জোজোবা (Jojoba) গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Simmondsia chinensis। এটি একটি মরু-সহিষ্ণু, দীর্ঘজীবী চিরহরিৎ ঝোপজাতীয় গাছ। প্রথমে উত্তর আমেরিকার মরু অঞ্চলে এর জন্ম হয়, বিশেষত অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া ও উত্তর মেক্সিকোতে। এই গাছ মূলত বুনোভাবে জন্মালেও এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বানিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে।

জোজোবা গাছের নাম শুনলেই প্রথমে তেলের কথা মনে আসে। আসলে এর বীজ থেকে প্রাপ্ত তেলেই লুকিয়ে আছে এই উদ্ভিদের মূল আকর্ষণ। বিশ্বে এই গাছ ‘Liquid Gold’ বা তরল সোনাও নামে পরিচিত, যার মূল কারণ এর বাণিজ্যিক ও চিকিৎসাগত গুরুত্ব।

আর পড়ুন: তমাল গাছ


জোজোবা গাছের গঠন ও বৈশিষ্ট্য

জোজোবা গাছ সাধারণত ১ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, তবে অনুকূল পরিবেশে এটি ৪ মিটার পর্যন্তও বড় হতে পারে। এটি একটি শুষ্কপ্রেমী গাছ, যার মূল খুব গভীরে প্রবেশ করে মাটির নিচের পানির স্তর থেকে জল সংগ্রহ করে। ফলে এটি মরু অঞ্চলেও টিকে থাকতে সক্ষম।

জোজোবা গাছের পাতা মোটা, চামড়ার মতো শক্ত ও রূপালি সবুজ বর্ণের। পাতাগুলোর উপর একটি মোমের আবরণ থাকে, যা পানি বাষ্পীভবন কমিয়ে দেয়।

এই গাছের ফুল সাধারণত একলিঙ্গিক হয়। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা গাছে জন্মে, যা বায়ুর মাধ্যমে পরাগায়িত হয়। ফলগুলি ক্যাপসুল ধরনের এবং এর ভিতরে থাকে দুটি থেকে তিনটি বাদামি রঙের বীজ, যেখান থেকে মূল্যবান জোজোবা তেল বের করা হয়।


বাংলাদেশে জোজোবা গাছের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে জোজোবা গাছের চাষ এখনো বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়নি, তবে কৃষি গবেষকদের মতে এটি আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তরাঞ্চলের শুষ্ক এলাকা ও উপকূলীয় অঞ্চলে সফলভাবে জন্মাতে পারে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় পানি সংকট রয়েছে সেখানকার জন্য এটি একটি সম্ভাবনাময় উদ্ভিদ।

বাংলাদেশের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়া, দীর্ঘ সময়ের রোদ এবং মাঝারি পরিমাণ বৃষ্টিপাত জোজোবা চাষের জন্য অনুকূল হতে পারে। এই গাছ অল্প পানি ও কম যত্নে টিকে থাকতে পারে, ফলে এটি খরাপ্রবণ এলাকায় কৃষকের জন্য উপযুক্ত বিকল্প।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী প্রভৃতি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চাইলে এই গাছকে একটি বিকল্প নগদ ফসল হিসেবে উন্নীত করতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) বা বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা কেন্দ্র (BAPARD) এ ধরনের মরুপ্রেমী উদ্ভিদের উপযোগিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করলে তা ভবিষ্যতের কৃষি বৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।


জোজোবা বীজ ও তেল – এক অলৌকিক উপাদান

জোজোবা গাছের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হলো এর বীজ। প্রতিটি বীজে প্রায় ৫০% পর্যন্ত তেল থাকে। এই তেল দেখতে সোনালি রঙের এবং গন্ধহীন।

জোজোবা তেল আসলে একটি তরল মোম, যা ত্বকের সিবাম (Sebum) এর গঠনের সাথে প্রায় মিল রয়েছে। এতে রয়েছে:

  • ইস্টার (Esters)

  • ফ্যাটি অ্যাসিড

  • ভিটামিন E

  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট

তেল উত্তোলন প্রক্রিয়া

জোজোবা তেল সাধারণত কোল্ড প্রেস পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হয়, যাতে তেলের পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। প্রতিকেজি বীজ থেকে প্রায় ৪৫০-৫০০ মিলি তেল পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে বিশুদ্ধ জোজোবা তেলের দাম প্রতি লিটার ৭০ থেকে ১২০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮০০০ থেকে ১৩০০০ টাকা।

জোজোবা বীজ ও তেল


জোজোবা গাছের প্রধান ব্যবহার

জোজোবা তেল বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যা এই গাছকে বহুমুখী করে তোলে।

প্রসাধনী শিল্পে ব্যবহার

  • ময়েশ্চারাইজার

  • ফেস অয়েল

  • লিপ বাম

  • চুলের কন্ডিশনার

  • বডি লোশন
    বিশ্বের প্রায় সব বড় বড় স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ড যেমন The Body Shop, L’Oréal, Neutrogena জোজোবা তেল ব্যবহার করে।

ঔষধি গুণাবলি

  • ব্রণ ও একজিমা উপশমে সহায়ক

  • ত্বকের জ্বালা কমায়

  • সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর

কৃষি ও শিল্পে ব্যবহার

  • বায়োডিজেল তৈরিতে সম্ভাব্য উপাদান

  • কাঠ ও ধাতব পণ্য পালিশে

  • পশুখাদ্য হিসেবে জোজোবার বর্জ্য অংশ ব্যবহারযোগ্য


জোজোবা গাছের স্বাস্থ্য উপকারিতা

জোজোবা তেলের স্বাস্থ্য উপকারিতা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর অনেক ওষধি গুণও রয়েছে।

ত্বক ও চুলের যত্নে

  • প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে

  • চুলে ব্যবহার করলে খুশকি কমায়

  • স্ক্যাল্পে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়

অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ

  • ত্বকে ফোলাভাব ও লালচে ভাব কমায়

  • সেল রিজেনারেশনে সাহায্য করে

অন্যান্য প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য উপকারিতা

  • ঠোঁট ফাটার প্রতিকার

  • হাত-পায়ের রুক্ষতা দূর করতে সাহায্য করে

  • নখের যত্নে কার্যকর


পরিবেশগত গুরুত্ব ও ভূমিকা

জোজোবা গাছ শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও এটির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

এই গাছের শিকড় গভীরে প্রবেশ করে, যার ফলে এটি বালির স্তর আটকে রাখতে সাহায্য করে। মরু অঞ্চল বা উঁচু ঢালু এলাকায় মাটি ক্ষয় রোধে কার্যকর।

জোজোবা গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশে অক্সিজেন যোগায়। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধেও একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে।

জোজোবার পাতা ও শাখাগুলি ধুলাবালি শোষণ করতে পারে, যা শহরাঞ্চলে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।

জোজোবা গাছ চাষে প্রয়োজনীয় আবহাওয়া ও মাটি

জোজোবা গাছ মরুভূমির উদ্ভিদ হলেও এর জন্য বিশেষ ধরনের আবহাওয়া ও মাটি প্রয়োজন।

আবহাওয়া

  • শুষ্ক, উষ্ণ জলবায়ু সবচেয়ে উপযোগী

  • ১৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে

  • বৃষ্টিপাত খুব কম হওয়া উচিত, বছরে ২৫০–৫০০ মিমি যথেষ্ট

মাটির ধরন

  • বেলে, বেলে-দোআঁশ এবং অল্প পাথুরে মাটি উপযোগী

  • pH ৫.৫ থেকে ৮.০ এর মধ্যে উপযুক্ত

  • পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, জলাবদ্ধতা সহ্য করে না

আলো ও রোদ

  • পূর্ণরোদে ভালো বৃদ্ধি পায়

  • ছায়াযুক্ত স্থানে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে


জোজোবা গাছের চারা রোপণ ও পরিচর্যা

সঠিকভাবে চারা রোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে এই গাছ থেকে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।

রোপণ পদ্ধতি

  • ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়

  • গাছের দূরত্ব: সারি থেকে সারি ৩ মিটার, গাছ থেকে গাছ ২ মিটার

  • গর্তের আকার: ৪৫x৪৫x৪৫ সেমি

  • গর্তে ১০ কেজি গোবর, হাড়ের গুঁড়ো, ছাই, মাটি মিশিয়ে দিতে হবে

পরিচর্যা

  • বছরে ২ বার আগাছা পরিষ্কার

  • শুষ্ক মৌসুমে ১৫–২০ দিন পরপর হালকা পানি

  • বছরে ১–২ বার জৈব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে

  • পুরুষ গাছ কমিয়ে স্ত্রী গাছের সংখ্যা বাড়ানো ভালো (১০:১ অনুপাতে পুরুষ:স্ত্রী)

আর পড়ুন: পিপল গাছ 


রোগ ও পোকামাকড় সমস্যা এবং প্রতিকার

জোজোবা গাছ সাধারণত রোগমুক্ত থাকলেও কিছু সমস্যা হতে পারে।

  • পাতায় সাদা দাগ বা ফাঙ্গাস

  • তেলবীজে পোকা আক্রমণ

  • পাতায় রোগ দেখা দিলে বোর্দো মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে

  • বীজে পোকা ধরলে সূর্যের আলোতে শুকানো

  • গাছে কীটনাশক প্রয়োগের আগে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি বিবেচনা করা উচিত


জোজোবা গাছ থেকে লাভজনক ফসল সংগ্রহ

জোজোবা গাছ প্রথম ২–৩ বছর তেমন ফল না দিলেও চতুর্থ বছর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়।

  • এক গাছ থেকে বছরে গড়ে ১–১.৫ কেজি বীজ পাওয়া যায়

  • পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে ৩–৪ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন হতে পারে

  • প্রতি একরে প্রায় ৮০০ গাছ রোপণ করা যায়

  • চাষের খরচ ৫০,০০০–৬০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে

  • বছরে প্রতি একরে ১২০০–২০০০ কেজি বীজ উৎপাদন সম্ভব

  • আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি বীজের দাম ৫–৭ ডলার পর্যন্ত হতে পারে


জোজোবা তেলের আন্তর্জাতিক বাজার ও চাহিদা

জোজোবা তেলের জন্য বিশ্বব্যাপী বড় এক বাজার রয়েছে।

  • ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, কোরিয়া, ভারত সহ বহু দেশে চাহিদা অত্যন্ত বেশি

  • শুধুমাত্র কসমেটিক্সেই বছরে প্রায় ২০,০০০ টন তেলের চাহিদা রয়েছে

বাংলাদেশ যদি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে, তাহলে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব। বিশেষ করে জৈব চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করলে বাজারে বাড়তি মূল্য পাওয়া যায়।


জোজোবা গাছ বনাম অন্যান্য তেলজাত গাছ

জোজোবা গাছকে তুলনা করা যায় অন্যান্য তেলজাত গাছ যেমন তিসি, সরিষা বা অরগান গাছের সঙ্গে।

বিষয় জোজোবা তিসি অরগান
উৎপাদন ১.৫–২ টন/হেক্টর ১–১.২ টন ১–১.৫ টন
তেলের ধরন তরল মোম ফ্যাটি অ্যাসিড ফ্যাটি অ্যাসিড
সংরক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী দ্রুত অক্সিডাইজ হয় মাঝারি স্থায়িত্ব
বাজার মূল্য বেশি কম বেশি

জোজোবা তেল নন-কমেডোজেনিক, অর্থাৎ এটি ত্বকের ছিদ্র বন্ধ করে না। এই দিক থেকে এটি প্রসাধনী শিল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


বাংলাদেশে জোজোবা চাষের ভবিষ্যৎ ও সরকারের করণীয়

বাংলাদেশের কৃষি এখন বহুমুখীকরণের দিকে এগোচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জোজোবা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

  • গবেষণা ও চাষ সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি

  • পরীক্ষামূলক চাষের জন্য কৃষকদের অনুদান ও প্রশিক্ষণ প্রদান

  • রপ্তানি নীতিতে জোজোবা তেলকে অগ্রাধিকার দেওয়া

এই খাত কৃষকদের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্যও একটি বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি করতে পারে।


জোজোবা গাছ নিয়ে ভুল ধারণা ও বাস্তবতা

বাজারে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে, যেমন জোজোবা গাছ শুধুই মরুভূমিতে জন্মায় বা এটি বাংলাদেশে জন্মাতে পারে না। বাস্তবে এসব ভুল ধারণা।

  • বাংলাদেশে উপযুক্ত জায়গায় চাষ সম্ভব

  • এটি অর্থকরী ফসল হিসেবে উন্নত হতে পারে

  • তেল সংগ্রহের প্রযুক্তি সহজলভ্য ও পরিবেশবান্ধব

আর পড়ুন: আকন্দ গাছ 


উপসংহার

জোজোবা গাছ কেবল একটি সৌন্দর্য উপাদান নয়, এটি একটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী গাছ। বাংলাদেশের জলবায়ু, খরাপ্রবণ অঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় এর চাষ সম্ভাবনাময়। সরকারি এবং বেসরকারি খাতে একযোগে প্রচেষ্টা চালানো হলে এটি দেশের কৃষিতে বৈচিত্র্য আনতে পারে। আপনার করণীয়:

  • যদি আপনি একজন উদ্যোক্তা হন, তাহলে জোজোবা চাষ নিয়ে ভাবুন

  • তথ্যটি ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন

  • আরও এমন তথ্যবহুল কনটেন্ট পেতে আমাদের ফলো করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *