জেব্রিনা গাছ বাংলাদেশের বাগানপ্রেমীদের কাছে বর্তমানে বেশ পরিচিত একটি নাম। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Tradescantia zebrina হলেও অনেক স্থানে একে Wandering Jew বা Inch Plant বলেও ডাকা হয়। আমাদের দেশে এটি সাধারণত ‘জেব্রিনা’ নামেই পরিচিত। এই গাছ মূলত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ট্রপিক্যাল অঞ্চল থেকে এসেছে, তবে বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশে এটি বাড়ির ভেতর ও বাইরের সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
জেব্রিনা গাছ দেখতে বেশ দৃষ্টিনন্দন। পাতাগুলোতে বেগুনি, রূপালি ও সবুজ রঙের মিশ্রণ থাকে, যা সহজেই যে কোনো ঘরের পরিবেশে শোভা বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই গাছ খুবই উপযোগী, কারণ আমাদের উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়ায় জেব্রিনা গাছ খুব সহজেই বেড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের নার্সারিগুলোতে এই গাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কারণ, এটি খুব সহজে রোপণ করা যায় এবং বড় করার জন্য কঠিন পরিচর্যা লাগে না। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালসহ বড় শহরগুলোতে প্রায় প্রতিটি নার্সারিতে জেব্রিনা গাছের চারা পাওয়া যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে জেব্রিনা গাছের গড় দাম প্রায় ৮০ টাকা থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে থাকে, যা মূলত গাছের আকার ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে। টবসহ গাছের দাম কিছুটা বেশি হয়, সাধারণত ১৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত।
এই গাছের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং অনেক বছর ধরে টিকে থাকে। তাই একবার কিনলেই দীর্ঘদিন ঘর বা বারান্দা সাজানো সম্ভব।
জেব্রিনা গাছের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য
জেব্রিনা গাছের মূল আকর্ষণ হলো এর চোখ ধাঁধানো পাতা। পাতার ওপরের দিকে হালকা সবুজ আর রূপালি রেখা থাকে, আর নিচের অংশটা হয় গাঢ় বেগুনি রঙের। পাতাগুলো দেখতে বেশ ঘন এবং হালকা মোমের মতো চকচকে হয়।
এই গাছ মূলত ঝোপাকৃতি হয়ে বেড়ে ওঠে। ডাঁটা বা কান্ডগুলো কিছুটা নরম ও মোটা হয় এবং সহজেই মাটির সংস্পর্শে এলে নতুন শেকড় তৈরি করে। তাই জেব্রিনা গাছ খুব দ্রুত জায়গা দখল করতে পারে।
জেব্রিনার বিভিন্ন জাত রয়েছে, যেমন:
-
Tradescantia zebrina ‘Purpusii’ – গাঢ় বেগুনি পাতার জাত।
-
Tradescantia zebrina ‘Quadricolor’ – বহুরঙা পাতার জাত, এতে রূপালি, গোলাপি, সবুজ ও বেগুনি রঙের মিশ্রণ থাকে।
এছাড়া অনেকেই নিজের পছন্দ অনুযায়ী কেটে-ছেঁটে আকৃতি ঠিক করে নেন। ঝুলন্ত টবে জেব্রিনা গাছ দারুণ মানায়, কারণ এর ডাঁটা ঝুলে ঝুলে পড়ে, যা ঘরের সাজে নতুন মাত্রা যোগ করে।
আপনি চাইলে বারান্দা, ছাদ কিংবা অফিস ডেস্কেও রাখতে পারেন এই গাছ। কারণ, এটি অল্প জায়গায়ও বড় হতে পারে।
আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো, জেব্রিনা গাছ খুব দ্রুত বাড়ে। সাধারণত ১-২ মাসেই বেশ বড় আকার ধারণ করে। এমনকি বাংলাদেশে অনেকেই পুরনো গাছ থেকে সহজে নতুন চারা তৈরি করে বাড়তি গাছ সংগ্রহ করেন।
আর পড়ুন: আফিম গাছ কী
জেব্রিনা গাছের উপকারিতা
জেব্রিনা গাছ শুধুমাত্র সৌন্দর্য বাড়ায় না, এর রয়েছে আরও অনেক কার্যকরী উপকারিতা। যারা ঘর-বাড়িতে সবুজ রাখতে চান, তাদের জন্য এটি একদম উপযুক্ত গাছ।
স্বাস্থ্য উপকারিতা
জেব্রিনা গাছ ঘরের বাতাস শোধনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর পাতা বাতাস থেকে ক্ষতিকর উপাদান শোষণ করে, যা পরিবেশকে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, জেব্রিনা গাছ ঘরের ভেতরের বায়ুর মধ্যে থাকা ফরমালডিহাইড, বেনজিন ইত্যাদি রাসায়নিক উপাদান কমাতে সহায়ক।
এছাড়া ঘরে সবুজ গাছ থাকলে মন ভালো থাকে, মানসিক চাপ কমে এবং মানসিক প্রশান্তি আসে। যারা সারাদিন কাজের চাপ ও ক্লান্তির মধ্যে থাকেন, তাদের জন্য জেব্রিনা গাছ হতে পারে এক প্রাকৃতিক ‘স্ট্রেস রিলিভার’।
বাসা ও কর্মস্থলে সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা
জেব্রিনা গাছ ঘরের অভ্যন্তরকে যেমন সুন্দর করে, তেমনি কর্মস্থলেও দারুণ মানিয়ে যায়। টেবিলের কোণ, জানালার পাশে কিংবা বারান্দার দেয়ালে এই গাছ ঝুলিয়ে রাখলে চোখে পড়ে এক অন্যরকম শোভা।
বিশেষ করে বেগুনি ও রূপালি পাতার মিশ্রণ ঘরের সাজসজ্জায় নান্দনিক সৌন্দর্য যোগ করে, যা অতিথিদের নজর কাড়ে।
সহজ পরিচর্যার জন্য জনপ্রিয়তা
জেব্রিনা গাছের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো এর সহজ পরিচর্যা। খুব বেশি পরিচর্যা ছাড়াই এই গাছ সহজে বড় হয়। শুধু সামান্য পানি ও পর্যাপ্ত আলো পেলেই এর বৃদ্ধি হয় চোখে পড়ার মতো।
বাংলাদেশের যারা ব্যস্ত জীবনে সহজে পরিচর্যা করা যায়, এমন গাছ খুঁজছেন, তাদের জন্য জেব্রিনা গাছ একেবারে পারফেক্ট।
জেব্রিনা গাছের যত্নবিধি (Complete Guide)
যারা জেব্রিনা গাছ কিনতে চান বা ঘরে লাগাতে চান, তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর সঠিক যত্ন। নিচে ধাপে ধাপে গাইড দেওয়া হলো।
আলো
জেব্রিনা গাছের পাতা ঠিকভাবে উজ্জ্বল ও চকচকে রাখতে পর্যাপ্ত আলো দরকার।
-
আদর্শ আলো: উজ্জ্বল, কিন্তু পরোক্ষ সূর্যের আলো।
-
ঘরের জন্য: জানালার পাশে বা যেখানে সূর্যের আলো ছায়া হয়ে পড়ে, সেই জায়গা সবচেয়ে ভালো।
-
বাইরের জন্য: আংশিক ছায়া বা সকাল বেলার সূর্য উত্তম।
ধরে রাখতে হবে, বেশি রোদে পাতার রং ফ্যাকাশে হয়ে যেতে পারে আবার খুব কম আলোতে পাতা ঝরতে পারে।
পানি
জেব্রিনা গাছ পানির প্রতি কিছুটা সংবেদনশীল।
-
পানির নিয়ম: মাটি শুকিয়ে গেলে পানি দিতে হবে।
-
সাধারণত গ্রীষ্মে ২-৩ দিন পরপর পানি লাগে।
-
শীতে পানি কম লাগবে, ৫-৭ দিন পরপর যথেষ্ট।
-
অতিরিক্ত পানি দিলে শিকড় পচে যেতে পারে।
মাটি
জেব্রিনা গাছের জন্য প্রয়োজন উর্বর ও ঝুরঝুরে মাটি।
-
মাটির মিশ্রণ: দোআঁশ মাটি, জৈব সার ও বালি মিশিয়ে ব্যবহার করা ভালো।
-
বাজারে পাওয়া “Ready Mix Soil” ৫০-৭০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, যা জেব্রিনার জন্য উপযুক্ত।
সার
গাছের পাতা উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান রাখতে নিয়মিত সার দেওয়া উচিত।
-
সার ব্যবহারের সময়: প্রতি ১-২ মাসে একবার।
-
সার নির্বাচন: জৈব সার বা ভার্মিকম্পোস্ট সবচেয়ে ভালো।
-
বাজারমূল্য: ১ কেজি জৈব সার ৫০-১০০ টাকা, ভার্মিকম্পোস্ট ১৫০-২০০ টাকা।
-
টিপস: লিকুইড ফার্টিলাইজারও ব্যবহার করা যায়, প্রতি ১৫ দিনে একবার।
আবহাওয়া ও তাপমাত্রা
বাংলাদেশের আবহাওয়া জেব্রিনার জন্য আদর্শ।
-
তাপমাত্রা: ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
-
খুব ঠান্ডা বা ১৫ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা হলে পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
-
আর্দ্রতা: হালকা আর্দ্রতা প্রয়োজন। ঘরের হিউমিডিটি কম হলে পানির স্প্রে করা যেতে পারে।
রোগ ও পোকামাকড় থেকে সুরক্ষা
জেব্রিনা গাছ তুলনামূলকভাবে কম রোগে আক্রান্ত হয়, তবে কিছু সতর্কতা প্রয়োজন।
-
সাধারণ রোগ: পাতার পচন, শিকড় পচন, ধবল দাগ।
-
পোকামাকড়: মাকড়সা জাতীয় পোকা, অ্যাফিড ইত্যাদি।
-
প্রতিরোধ উপায়:
-
ঘরোয়া পদ্ধতি: নিম তেল (২০-৩০ টাকা) মিশ্রিত পানি স্প্রে করা।
-
অর্গানিক কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
-
জেব্রিনা গাছের কাটিং ও নতুন চারা তৈরির পদ্ধতি
জেব্রিনা গাছের সবচেয়ে চমৎকার বিষয়গুলোর একটি হলো সহজে কাটিং বা স্টেম কাটিং পদ্ধতিতে নতুন চারা তৈরি করা যায়। বাংলাদেশে অনেকেই খুব সহজে এই পদ্ধতিতে গাছ বাড়িয়ে থাকেন।
কাটিংয়ের সেরা সময়
জেব্রিনা গাছের কাটিংয়ের জন্য সাধারণত বসন্তকাল (ফাল্গুন-চৈত্র) এবং গ্রীষ্মকাল সবচেয়ে উপযোগী। এই সময় গাছ দ্রুত মূল গজায় ও বাড়ে। তবে শীতকালেও ঘরের ভিতরে কাটিং করা যায়, তবে একটু বেশি সময় লাগে।
কাটিং পদ্ধতি ধাপে ধাপে
ধাপ ১: উপযুক্ত ডাঁটা নির্বাচন করুন
-
স্বাস্থ্যবান, সবুজ ও পরিপক্ক ডাঁটা বেছে নিতে হবে।
-
ডাঁটায় অন্তত ৩-৪টি গাঁঠ থাকতে হবে।
-
পাতা ঝরাপড়া বা রোগাক্রান্ত ডাঁটা কখনও ব্যবহার করবেন না।
ধাপ ২: সঠিকভাবে কাটিং করা
-
ধারালো ও পরিষ্কার কাঁচি বা ব্লেড ব্যবহার করুন।
-
গাঁঠের ১-২ ইঞ্চি নিচ থেকে ৪-৬ ইঞ্চি লম্বা করে কাটুন।
-
কাঁচি জীবাণুমুক্ত করতে চাইলে আগে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে পারেন।
ধাপ ৩: পানিতে ডুবিয়ে রাখা
-
কাটা ডাঁটাগুলো পরিষ্কার পানিতে ডুবিয়ে রাখুন।
-
গাঁঠের অংশগুলো পানিতে রাখতে হবে।
-
স্বচ্ছ কাঁচের বোতলে রাখলে মূলের অগ্রগতি দেখা যায়।
-
৫-১০ দিনে মূল বের হতে শুরু করবে।
ধাপ ৪: নতুন মূল তৈরি হলে পাত্রে লাগানো
-
শিকড় ১-২ ইঞ্চি বড় হলে, পছন্দমতো টব বা মাটিতে লাগিয়ে দিন।
-
রোপণের পর হালকা পানি দিতে হবে।
-
প্রথমদিকে সরাসরি রোদে না রেখে ছায়াযুক্ত জায়গায় রাখুন।
ধাপ ৫: রুট হরমোন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা (যদি প্রয়োজন হয়)
-
রুট হরমোন ব্যবহারে মূল গজানো দ্রুত হয়।
-
বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায় এমন পাউডার রুট হরমোনের দাম ৫০-৮০ টাকা।
-
এটি ব্যবহার করলে ৩০-৫০% দ্রুত রুটিং হয়।
কাটিংয়ের সফলতা বাড়ানোর টিপস
-
শীতের সময় পানির বদলে সরাসরি মাটিতে লাগানো ভালো।
-
মাঝে মাঝে পানির পরিবর্তন করুন, যাতে পচন না ধরে।
-
বেশি আলো ও হালকা উষ্ণ স্থানে কাটিং রাখলে মূল দ্রুত বের হয়।
-
নিমপাতার জল বা নিম তেল স্প্রে করলে ছত্রাকের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ঘরোয়া সহজ উপকরণ দিয়ে কাটিং
-
পুরনো প্লাস্টিকের বোতল কেটে জার বানিয়ে ব্যবহার করুন।
-
লবণজল দিয়ে কাটিংয়ের বোতল ধুয়ে নিতে পারেন।
বাংলাদেশি আবহাওয়ার উপযোগী পদ্ধতি
বাংলাদেশের উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়ায় সবচেয়ে ভালো কাটিং পদ্ধতি হলো:
-
মাটির পাত্রে জৈব সার মেশানো মাটি ব্যবহার।
-
হালকা ছায়ায় রেখে মাঝেমধ্যে পানি দেওয়া।
-
১৫-২০ দিনের মধ্যে গাছ বড় হতে শুরু করে।
আর পড়ুন: কদবেল গাছ
জেব্রিনা গাছ রোপণের সেরা পদ্ধতি ও কৌশল
সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করলে জেব্রিনা গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ঝাঁকড়া হয়। নিচে বাংলাদেশে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি দেওয়া হলো।
টবে রোপণ
-
মাঝারি সাইজের টব নির্বাচন করুন, যার নিচে পানি বের হওয়ার ছিদ্র আছে।
-
৭০% দোআঁশ মাটি, ২০% বালি, ১০% জৈব সার মিশিয়ে মাটি প্রস্তুত করুন।
-
কাটিং বা চারা রোপণ করে হালকা চাপ দিন।
-
প্রথম ৭ দিন ছায়ায় রাখুন, তারপর আলোতে আনুন।
ঝুলন্ত পাত্রে রোপণ
-
ঝুলন্ত পাত্র জেব্রিনার জন্য আদর্শ, কারণ এর ডাঁটা নিচে ঝুলে পড়ে।
-
টবের আকার ৮-১২ ইঞ্চি হলে ভালো হয়।
-
পাত্রের নিচে ছিদ্র রাখুন পানি নিষ্কাশনের জন্য।
-
হালকা পানি ও পর্যাপ্ত আলোয় রাখুন।
সরাসরি মাটিতে রোপণ
-
বাগানে বা ছাদে সরাসরি মাটিতে রোপণ করা যায়।
-
মাটিতে জৈব সার ও পচা গোবর মিশিয়ে নিন।
-
৬-৮ ইঞ্চি গভীর গর্তে চারা লাগান।
-
শুকনো আবহাওয়ায় প্রতিদিন পানি দিতে হবে।
-
সরাসরি রোদ এড়াতে প্রথম ১০ দিন ছায়া দিন।
পুরাতন গাছ পুনরুজ্জীবিত করার কৌশল
-
পুরনো গাছে যদি পাতা শুকিয়ে যায় বা বৃদ্ধির গতি কমে যায়:
-
পুরনো ডাঁটা ছেঁটে দিন।
-
নতুন পাতা গজানোর জন্য পানি ও সার দিন।
-
নিচের পাতাগুলো ঝরলে মাটি বদল করে দিন।
-
প্রয়োজনে নতুন কাটিং লাগিয়ে পুরনো গাছের পাশে রোপণ করুন।
-
জেব্রিনা গাছের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও পণ্য
সঠিক সরঞ্জাম ও উপকরণ থাকলে জেব্রিনা গাছের যত্ন নেওয়া আরও সহজ হয়। নিচে বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায় এমন প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকা দেওয়া হলো।
ভালো মানের টব
-
প্লাস্টিক, সিমেন্ট অথবা মাটির টব ব্যবহার করা যায়।
-
ছোট টব (৬-৮ ইঞ্চি) ৭০-১৫০ টাকা।
-
মাঝারি টব (১০-১২ ইঞ্চি) ১৫০-৩০০ টাকা।
পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা
-
টবের নিচে ড্রেনেজ হোল থাকা বাধ্যতামূলক।
-
চাইলে আলাদা ড্রেনেজ ট্রে কিনতে পারেন, দাম ৪০-৭০ টাকা।
সার, মাটি, কাটার কাঁচি, স্প্রে বোতল
-
জৈব সার: ৫০-১০০ টাকা প্রতি কেজি।
-
বালি: ২০-৩০ টাকা প্রতি কেজি।
-
কাটার কাঁচি: ১০০-২০০ টাকা।
-
স্প্রে বোতল: ৭০-১৫০ টাকা।
-
রুটিং হরমোন: ৫০-৮০ টাকা।
বাংলাদেশি বাজারের পণ্য
-
নার্সারি ও কৃষি দোকানে সহজে পাওয়া যায়।
-
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন Daraz, Rokomari Garden Store, Facebook Garden Shop-এও পাওয়া যায়।
জেব্রিনা গাছ কেনার গাইড- কোথায় পাবেন?
বাংলাদেশে জেব্রিনা গাছ পাওয়া এখন খুব সহজ। নিচে উল্লেখ করা হলো কেনার কিছু কার্যকর গাইড।
বাংলাদেশে জেব্রিনা গাছের জনপ্রিয়তা
-
ঢাকার সাতরাস্তা, শাহবাগ, আগারগাঁও, উত্তরা, বনানী—এই এলাকাগুলোর নার্সারিতে সহজে পাওয়া যায়।
-
চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল—প্রায় সব শহরে নার্সারিতে জেব্রিনা গাছ পাওয়া যায়।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে জেব্রিনা গাছ কেনা
বর্তমানে অনেক অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও জেব্রিনা গাছ পাওয়া যাচ্ছে:
-
Facebook Marketplace: দাম ৮০-২০০ টাকা।
-
Daraz: টবসহ গাছের দাম ১৫০-৩৫০ টাকা।
-
Evaly, Othoba: কখনও কখনও ডিসকাউন্টে পাওয়া যায়।
-
ডেলিভারি চার্জ সাধারণত ৫০-১০০ টাকা।
স্থানীয় নার্সারি থেকে কেনার সুবিধা ও টিপস
-
নিজে গিয়ে পছন্দমতো গাছ বাছাই করা যায়।
-
দাম কিছুটা কম হয়, দরাদরি করা যায়।
-
গাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা সম্ভব।
-
টিপস:
-
পাতা ভালো করে দেখুন, দাগ বা পচন আছে কিনা।
-
শেকড় ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করুন।
-
বেশি পুরনো বা খুব বড় গাছ না কেনাই ভালো।
-
গাছ কেনার সময় কী কী লক্ষ্য করবেন
-
গাছের পাতা উজ্জ্বল ও দাগমুক্ত কিনা।
-
ডাঁটা মজবুত ও সবুজ কিনা।
-
শেকড় গজানো আছে কিনা।
-
গাছের বয়স খুব বেশি নয় কিনা।
-
পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা।
জেব্রিনা গাছ পরিচর্যায় কিছু সাধারণ ভুল এবং সমাধান
জেব্রিনা গাছের যত্ন সহজ হলেও কিছু সাধারণ ভুলের কারণে অনেক সময় এই গাছ নষ্ট হয়ে যায় বা ঠিকভাবে বড় হয় না। প্রথমত, অনেকেই মনে করেন বেশি পানি দিলে গাছ ভালো বাড়বে। কিন্তু জেব্রিনা গাছের জন্য অতিরিক্ত পানি সবচেয়ে বড় শত্রু। যদি মাটিতে পানি জমে থাকে, তাহলে শিকড় পচে যায় এবং পুরো গাছ মারা যায়। সমাধান হলো, টব বা পাত্রের নিচে অবশ্যই ড্রেনেজ হোল রাখতে হবে এবং পানি দেওয়ার আগে দেখতে হবে মাটি শুকিয়েছে কি না।
আরেকটি সাধারণ ভুল হলো, খুব কম আলোতে গাছ রাখা। জেব্রিনা গাছের পাতা সুন্দর রাখার জন্য পর্যাপ্ত আলো দরকার। অনেকেই একেবারে অন্ধকার জায়গায় বা ঘরের গভীরে গাছ রাখেন, এতে পাতা ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং ঝরে পড়তে শুরু করে। এ সমস্যা এড়াতে গাছকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যেখানে ছায়া-আলো মিশ্রিত পরিবেশ থাকে।
ভুল মাটি ব্যবহার করাও একটি সাধারণ সমস্যা। অনেকেই ভারী মাটি ব্যবহার করেন যেখানে পানি জমে থাকে, এতে শিকড় পচে যায়। জেব্রিনা গাছের জন্য হালকা ও ঝুরঝুরে মাটি প্রয়োজন, যা পানি নিষ্কাশন ভালো করে। প্রয়োজন হলে বাজারের রেডি মিক্স পটিং মিক্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনেকে আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করেন, এতে গাছের পাতা পোড়া দাগ পড়ে এবং বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। জেব্রিনা গাছের জন্য অতিরিক্ত সার একেবারেই ক্ষতিকর। সাধারণত মাসে একবার জৈব সার ব্যবহার যথেষ্ট।
সবচেয়ে বড় যে ভুলটি হয়, তা হলো সঠিক ছাঁটাই না করা। অনেক সময় গাছের ডাঁটা লম্বা হয়ে গেলে সেটিকে ছাঁটা প্রয়োজন। না ছাঁটলে গাছ ঝুলে পড়ে এবং নিচের পাতা ঝরতে থাকে। ছাঁটাই করলে নতুন শাখা বের হয়, গাছ ঘন হয় এবং সৌন্দর্যও বাড়ে। এই কাজটি বছরে কয়েকবার করা উচিত।
জেব্রিনা গাছ নিয়ে বাংলাদেশি বাগানপ্রেমীদের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে বাগানপ্রেমীদের কাছে জেব্রিনা গাছ দিন দিন খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে, যেখানে বাড়ির জায়গা সীমিত, সেখানে জেব্রিনা গাছ ঝুলন্ত টব বা বারান্দায় অনন্য সৌন্দর্য যোগ করছে।
অনেক অভিজ্ঞ বাগানপ্রেমীরা বলেন, জেব্রিনা গাছের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো খুব কম যত্নে সুন্দর গাছ পাওয়া যায়। এক নার্সারি মালিকের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, তার গাছের দোকানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় এই জেব্রিনা গাছ, কারণ নতুন বাগানপ্রেমীরাও এটি সহজে বড় করতে পারেন।
একজন ঢাকার বাসিন্দা জানান, তার ছোট বারান্দায় মাত্র দুটি জেব্রিনা গাছ দিয়ে পুরো জায়গাটিই সবুজে ঢেকে গেছে, এবং তাতে বাড়ির সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেছে।
অনেকেই শেয়ার করেন, তারা প্রথমে বন্ধু বা প্রতিবেশীর কাছ থেকে জেব্রিনা গাছের কাটিং নিয়ে চারা তৈরি করেছেন, পরে সেটি থেকেই বহু গাছ জন্মেছে। কিছু বাগানপ্রেমী বলেন, তারা এই গাছের মাধ্যমে ছোটখাটো ব্যবসাও শুরু করেছেন।
বাংলাদেশে ফেসবুক গ্রুপগুলোতেও জেব্রিনা গাছ নিয়ে নানা আলোচনা হয়। “গার্ডেনিং বাংলাদেশ” বা “হোম গার্ডেন লাভার্স বাংলাদেশ” গ্রুপে অনেকেই নিজেদের কাটিং, চারা বিনিময় করেন এবং পরিচর্যার টিপস শেয়ার করেন। এসব প্ল্যাটফর্মে দেখা যায়, জেব্রিনা গাছ বিশেষ করে নতুন বাগানপ্রেমীদের প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে।
জেব্রিনা গাছ নিয়ে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
জেব্রিনা গাছ কি ঘরের ভিতরে রাখা যায়?
হ্যাঁ, জেব্রিনা গাছ ঘরের ভিতরে খুব ভালোভাবে রাখা যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ঘরে পর্যাপ্ত আলো পৌঁছায় এমন জায়গায় রাখতে হবে। জানালার পাশে বা বারান্দার কাছাকাছি জায়গা এ জন্য আদর্শ।
এই গাছ কি পোষা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর?
হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে জেব্রিনা গাছের পাতা পোষা প্রাণীর জন্য সামান্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে বিড়াল বা কুকুর যদি পাতা খেয়ে ফেলে, তবে তাদের হজমে সমস্যা হতে পারে। তাই পোষা প্রাণী থাকলে গাছটি এমন জায়গায় রাখুন, যেখানে তারা সহজে পৌঁছাতে না পারে।
কতদিন পরপর পানি দিতে হয়?
জেব্রিনা গাছের জন্য পানি দেওয়ার সময় নির্ভর করে মাটির শুকনো অবস্থার ওপর। সাধারণত গ্রীষ্মে ২-৩ দিন পরপর এবং শীতে ৫-৭ দিন পরপর পানি দেওয়া যায়। মাটি শুকিয়ে গেলে তবে পানি দিতে হবে।
কীভাবে সহজে কাটিং থেকে নতুন চারা তৈরি করা যায়?
জেব্রিনা গাছের কাটিং থেকে নতুন চারা তৈরি করা খুব সহজ। ডাঁটা কেটে পানিতে ডুবিয়ে রাখলেই ৫-৭ দিনের মধ্যে শিকড় বের হয়। তারপর শিকড়সহ মাটিতে লাগিয়ে দিলেই নতুন গাছ তৈরি হয়।
এই গাছের সবচেয়ে বড় উপকারিতা কী?
জেব্রিনা গাছের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো, এটি খুব সহজে বংশবৃদ্ধি করে এবং অল্প পরিচর্যায় ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়। পাশাপাশি এটি ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখতেও সহায়ক।
আর পড়ুন: বেল গাছ
উপসংহার
জেব্রিনা গাছ শুধু একটি গাছ নয়, বরং একটি সবুজ আনন্দের উৎস। যারা ঘর সাজাতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি একদম উপযুক্ত। সহজ পরিচর্যা, মনোমুগ্ধকর রঙ এবং দ্রুত বৃদ্ধি—এই তিনটি কারণেই জেব্রিনা গাছ বাংলাদেশের বাগানপ্রেমীদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এই গাছের যত্ন নিতে খুব বেশি কিছু জানতে হয় না। শুধু কয়েকটি সাধারণ নিয়ম মানলেই এটি সুস্থ ও সুন্দর থাকে। সঠিক আলো, পানি, মাটি ও সামান্য যত্নই এই গাছের সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট।
বিশেষ করে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এই গাছ খুব সহজে মানিয়ে যায়। গাছটি ঘরের ভিতর, বারান্দা কিংবা ছাদে সমানভাবে ভালো হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই গাছের মাধ্যমে ঘরের সৌন্দর্য যেমন বাড়ে, তেমনি মানসিক প্রশান্তিও মেলে।
আপনি যদি এখনও জেব্রিনা গাছ কিনে না থাকেন, তাহলে দেরি না করে এখনই নিজের জন্য অথবা প্রিয়জনের জন্য একটি জেব্রিনা গাছ সংগ্রহ করুন। গাছটিকে ভালোভাবে যত্ন নিন, নিয়মিত পানি দিন, আলোতে রাখুন আর দেখুন আপনার ঘর কতটা সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
আপনি যদি এই আর্টিকেলটি ভালো মনে করেন, তাহলে শেয়ার করুন, কমেন্ট করুন এবং আরও গাছপ্রেমীদের সাথে এই তথ্য ছড়িয়ে দিন। চাইলে আমাদের অন্যান্য গার্ডেনিং বিষয়ক আর্টিকেলও পড়তে পারেন।