চিয়া বীজ- পুষ্টিগুণ, উপকারিতা এবং ব্যবহারের সঠিক নিয়ম

চিয়া বীজ

চিয়া বীজ একটি ক্ষুদ্র কিন্তু পুষ্টিগুণে ভরপুর খাদ্য যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এটি মূলত একটি সুপারফুড হিসেবে পরিচিত কারণ এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসে সাধারণত চাল, ডাল এবং শাকসবজি প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিয়া বীজের মতো নতুন পুষ্টিকর উপাদানগুলোও এই তালিকায় যোগ হচ্ছে।
চিয়া বীজের ব্যবহার শুধু স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এটি ওজন কমানো, শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি হৃদরোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে অনেকেই জানেন না এটি কীভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হয় বা এটি কোথায় পাওয়া যায়। এ আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা চিয়া বীজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরব এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করব।

চিয়া বীজ কী

চিয়া বীজ হলো সালভিয়া হিস্পানিকা নামক উদ্ভিদের বীজ যা মূলত মেক্সিকো এবং গুয়াতেমালার স্থানীয় উদ্ভিদ। এটি লামিয়াসি পরিবারভুক্ত একটি উদ্ভিদ যা তুলসী গাছের সাথেও সম্পর্কিত। প্রাচীনকালে অ্যাজটেক এবং মায়ান সভ্যতার লোকেরা এটি তাদের প্রধান খাদ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করত। চিয়া শব্দের অর্থ শক্তি যা এই বীজের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা বোঝায়।

আর পড়ুন: বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল কাঠের গাছ 

এই বীজের আকৃতি ছোট, ওভাল এবং রঙ কালো ও সাদা মিশ্রিত। এর মধ্যে উচ্চ পরিমাণে ফাইবার, প্রোটিন এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। শুধু তাই নয় এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং বিভিন্ন মিনারেল যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়ামেও সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের বাজারে এটি একটি তুলনামূলক নতুন পণ্য হলেও এর জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে।

চিয়া বীজের পুষ্টিগুণ

চিয়া বীজকে পুষ্টির একটি পাওয়ার হাউস বলা হয়। এর প্রতিটি ১০০ গ্রামে নিম্নলিখিত পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান:

  • ক্যালরি: ৪৮৬ ক্যালরি
  • প্রোটিন: ১৬.৫ গ্রাম
  • ফাইবার: ৩৪.৪ গ্রাম
  • ফ্যাট: ৩০.৭ গ্রাম (এর মধ্যে অধিকাংশ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড)
  • ক্যালসিয়াম: ৬৩১ মিগ্রাম
  • আয়রন: ৭.৭২ মিগ্রাম
  • ম্যাগনেসিয়াম: ৩৩৫ মিগ্রাম
  • পটাসিয়াম: ৪০৭ মিগ্রাম

এই পুষ্টি উপাদানগুলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কার্যাবলীতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, ফাইবার হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠনে সহায়তা করে। এছাড়া চিয়া বীজের উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীর থেকে ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিক্যাল দূর করতে সাহায্য করে।

চিয়া বীজের উপকারিতা

চিয়া বীজের উপকারিতা বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। নিচে এর কয়েকটি প্রধান উপকারিতা তুলে ধরা হলো:

  • ওজন নিয়ন্ত্রণ: চিয়া বীজ ফাইবারে সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এটি পানিতে ভিজিয়ে খেলে এটি জেলাটিনের মতো হয়ে যায় যা পাকস্থলীতে পূর্ণতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। এর ফলে কম ক্যালরি গ্রহণ করেও দীর্ঘ সময় তৃপ্ত থাকা যায়।
  • হৃদযন্ত্রের সুস্থতা: চিয়া বীজে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমায়। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।
  • ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা: চিয়া বীজ রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। এর ফাইবার উপাদান রক্তে শর্করা শোষণের প্রক্রিয়া ধীর করে যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
  • হজমের উন্নতি: উচ্চ ফাইবার উপাদান হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। যারা হজমজনিত সমস্যায় ভোগেন তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার সমাধান।
  • ত্বক ও চুলের যত্ন: চিয়া বীজে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের বার্ধক্য রোধ করে এবং চুলের গুণগত মান উন্নত করে।

আর পড়ুন: উন্নত মানের শসা বীজ

চিয়া বীজের ব্যবহারের নিয়ম

এটি সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এর পুষ্টিগুণ থেকে সর্বোচ্চ উপকার পাওয়া যায়। তবে এর ব্যবহার সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি।

প্রতিদিন কতটুকু চিয়া বীজ খাওয়া উচিত

একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন ১-২ টেবিল চামচ (প্রায় ২০-২৫ গ্রাম) খেতে পারেন। তবে প্রথমবার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অল্প পরিমাণে শুরু করা উচিত কারণ ফাইবার বেশি থাকায় পেট ফাঁপার মতো সমস্যা হতে পারে।

কাঁচা ও রান্না করা চিয়া বীজ

এটি কাঁচা অবস্থায় সরাসরি খাওয়া যায়, তবে এটি পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া আরও ভালো। পানিতে ভিজিয়ে খেলে এটি একটি নরম জেলির মতো হয়ে যায় যা হজমে সহায়ক। রান্না করা  বিভিন্ন রেসিপিতে এটি যোগ করা যায়, যেমন স্মুদি, পুডিং বা সালাদ।

পানিতে ভিজিয়ে খাওয়ার পদ্ধতি

চিয়া বীজ পানিতে ভিজিয়ে খাওয়ার জন্য এক কাপ পানিতে ১-২ টেবিল চামচ চিয়া বীজ মেশান এবং অন্তত ২০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এটি ফুলে উঠে জেলির মতো হয়ে যাবে। এরপরে এটি পান করতে পারেন বা অন্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারেন।

চিয়া বীজ কোথায় পাওয়া যায়

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিয়া বীজ এখনও খুব বেশি প্রচলিত নয় তবে এটি এখন সহজেই বিভিন্ন অনলাইন এবং অফলাইন দোকানে পাওয়া যায়। ঢাকার বড় সুপার শপ যেমন শপন, আগোরা এবং মীনা বাজারে চিয়া বীজের ভালো সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়া দেশীয় ই-কমার্স ওয়েবসাইট যেমন দারাজ, পিকাবু এবং চালডাল ডটকমেও এটি অর্ডার করা যায়।

দাম: বাংলাদেশে চিয়া বীজের দাম নির্ভর করে এর ব্র্যান্ড এবং মানের ওপর। সাধারণত ৫০০ গ্রাম চিয়া বীজের দাম ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে থাকে। তবে বিদেশি ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে দাম একটু বেশি হতে পারে। কেনার সময় প্যাকেজিং এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেখে নেওয়া উচিত।

চিয়া বীজের বিভিন্ন রেসিপি

এটিকে বিভিন্নভাবে খাবারের সাথে মিশিয়ে নেওয়া যায়। এটি স্বাদহীন হওয়ায় যে কোনো ধরনের খাবারের সাথে সহজেই মানিয়ে যায়। নিচে কয়েকটি জনপ্রিয় রেসিপি দেওয়া হলো:

চিয়া পুডিং

  • উপকরণ: চিয়া বীজ, দুধ (বা বাদামের দুধ), মধু, ফল।
  • প্রস্তুতি: এক কাপ দুধের মধ্যে ২ টেবিল চামচ চিয়া বীজ মেশান এবং রাতভর ফ্রিজে রেখে দিন। সকালে এতে মধু ও কাটা ফল যোগ করুন।

স্মুদি

  • উপকরণ: পছন্দের ফল, দই, চিয়া বীজ।
  • প্রস্তুতি: একটি ব্লেন্ডারে সব উপকরণ মিশিয়ে একটি সুস্বাদু স্মুদি তৈরি করুন।

সালাদ টপিং

  • উপকরণ: সালাদের উপাদান, চিয়া বীজ।
  • প্রস্তুতি: সালাদের ওপর এক চা চামচ চিয়া বীজ ছিটিয়ে পরিবেশন করুন।

চিয়া বীজের বিভিন্ন প্রকার

এটি মূলত দুটি ধরনের হয়ে থাকে:

  • কালো চিয়া বীজ: এটি সর্বাধিক প্রচলিত। এগুলো সাধারণত সালভিয়া হিস্পানিকা উদ্ভিদের থেকে আসে এবং এতে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইবার থাকে।
  • সাদা চিয়া বীজ: এটি মূলত একই উদ্ভিদের একটি ভিন্ন জাত। এদের পুষ্টিগুণ কালো চিয়া বীজের প্রায় সমান তবে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায় যেমন সামান্য বেশি প্রোটিন বা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকতে পারে।
  • বীজের গুণগত মান: এটির গুণগত মান নির্ভর করে এর উৎপত্তি, সংগ্রহ প্রক্রিয়া এবং সংরক্ষণ পদ্ধতির ওপর। ভালো মানের চিয়া বীজ হালকা, খোসাহীন এবং আর্দ্রতামুক্ত থাকে।

আর পড়ুন: সাকুলেন্ট গাছের দাম 

চিয়া বীজ কোথায় পাওয়া যায়

এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন সুপারশপ, অনলাইন মার্কেটপ্লেস এবং স্বাস্থ্য পণ্যের দোকানে সহজেই পাওয়া যায়।

  • সুপারশপ: বাংলাদেশের বড় বড় সুপারশপ, যেমন আগোরা, মিনাবাজার এবং স্বপ্নতে এটি পাওয়া যায়।
  • অনলাইন মার্কেট: অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম, যেমন দারাজ, ফেসবুক ভিত্তিক শপ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যপণ্যের ওয়েবসাইটে এটি অর্ডার করা যায়। এর অনলাইনে ৫০০ গ্রামের  দাম প্রায় ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে হয়।
  • স্থানীয় বাজার: যদিও স্থানীয় খুচরা বাজারেএটি ততটা সহজলভ্য নয় তবু কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় স্বাস্থ্য পণ্য বিক্রেতারা এটি সরবরাহ করে থাকেন।

চিয়া বীজ

চিয়া বীজ কেনার সময় যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

এটি কেনার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত:

  • খাঁটি পণ্যের নিশ্চয়তা: চিয়া বীজ খাঁটি এবং মিশ্রণমুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় বাজারে নকল বা নিম্নমানের পাওয়া যায়।
  • মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য: মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য কেনা এড়ানো উচিত কারণ পুরনো বীজে এর পুষ্টিগুণ কমে যেতে পারে।
  • ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা: বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড থেকে এটি কিনলে মানের বিষয়ে নিশ্চিত থাকা যায়।

চিয়া বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি

এর পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • শুষ্ক ও শীতল জায়গায় রাখুন: এটি শুষ্ক এবং ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করা উচিত কারণ আর্দ্রতা এতে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
  • বায়ুরোধী পাত্র ব্যবহার করুন: বায়ুরোধী পাত্রে চিয়া বীজ রেখে দিলে তা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভালো থাকে।
  • দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ: এটি সাধারণত ১-২ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। তবে সংরক্ষণের সময় এটির রং এবং গন্ধের পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা লক্ষ করা উচিত।

চিয়া বীজ নিয়ে কিছু ভুল ধারণা

এটিকে নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে। এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি:

  • চিয়া বীজ শুধুমাত্র ওজন কমানোর জন্য: অনেকেই মনে করেন এটি শুধুমাত্র ওজন কমানোর জন্য উপকারী। তবে এটি হৃদরোগ, ত্বক এবং হজমের জন্যও সমান উপকারী।
  • চিয়া বীজ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না: এটি অত্যধিক পরিমাণে খেলে পেট ফাঁপা বা হজমের সমস্যা হতে পারে। তাই পরিমাণমতো খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
  • রান্না ছাড়া খাওয়া অনুচিত: এটি কাঁচা বা রান্না ছাড়া খাওয়া যায়। তবে এটি পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী।

আর পড়ুন: গাছের গোড়ায় কী দিলে গাছ মারা যায় 

উপসংহার

চিয়া বীজ একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর সুপারফুড যা স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের খাদ্য তালিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে এর ব্যবহার ও সহজলভ্যতা ক্রমেই বাড়ছে। তবে সঠিকভাবে ব্যবহার এবং সংরক্ষণ করলে এর পুষ্টিগুণ সর্বাধিক উপকারে আসে। এর সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং এটি ব্যবহারের নিয়ম জানার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনধারায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।
আপনি যদি এই আর্টিকেলটি উপকারী মনে করেন তবে এটি শেয়ার করতে এবং অন্যদের জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *