বাংলাদেশের বনজ সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গাছ হচ্ছে চাম্বল গাছ। এর ইংরেজি নাম Indian Rosewood এবং বৈজ্ঞানিক নাম Dalbergia sissoo। এটি একটি বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ যা ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে জন্মে থাকে। শক্ত কাঠ এবং উপকারী বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি বহু বছর ধরেই কাঠশিল্প, ওষুধ এবং পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে চাম্বল গাছ সাধারণত সমতল ভূমিতে বেশি দেখা যায়। এ গাছটি অত্যন্ত সহনশীল প্রকৃতির এবং খরা ও সামান্য খারাপ মাটিতেও বেঁচে থাকতে পারে। একদিকে এটি যেমন অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পরিবেশ রক্ষায়ও এর বড় ভূমিকা রয়েছে। এই কারণে চাম্বল গাছ শুধু বনজ সম্পদ নয়, বরং পরিবেশগত দিক থেকেও এক অনন্য উদাহরণ।
চাম্বল গাছ কী
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও বৈজ্ঞানিক নাম
চাম্বল গাছ Fabaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল গাছ যার কাঠ অত্যন্ত মজবুত এবং ঘন। বৈজ্ঞানিক নাম Dalbergia sissoo হলেও বাংলাদেশে এটি “শিশু”, “সিসসো” বা “চাম্বল” নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে একে North Indian Rosewood বলা হয়।
আর পড়ুন: জোজোবা গাছ
এই গাছটি সাধারণত ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছটি তার পরিপক্ব অবস্থায় শক্ত কাঠ উৎপাদন করে যা আসবাবপত্র, দরজা, জানালা, কাঠের তক্তা ও জাহাজ নির্মাণে বহুল ব্যবহৃত হয়। শুধু কাঠই নয়, এর ছাল, পাতা এবং ফলও বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকারী।
চাম্বল গাছের স্থানীয় নাম ও অন্যান্য নাম
বাংলাদেশে এটি মূলত “চাম্বল” নামেই পরিচিত হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একে ভিন্ন নামে ডাকা হয়। উদাহরণস্বরূপ—
-
রাজশাহী অঞ্চলে একে “শিশু গাছ” বলা হয়
-
সিলেটের কোনো কোনো এলাকায় এটি “সিসসু” নামে পরিচিত
-
ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে একে “টাহলি” বা “টাহল” বলা হয়
এই গাছের বহুল প্রচলিত ব্যবহার ও বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি উপমহাদেশজুড়ে পরিচিত ও জনপ্রিয়।
চাম্বল গাছের বৈশিষ্ট্য
চাম্বল গাছ একটি মধ্যম থেকে বড় আকৃতির বৃক্ষ যা প্রাকৃতিকভাবে সোজা ও দীর্ঘ হয়। এর কাঠ অত্যন্ত শক্ত, টেকসই এবং ঘন। এই গাছের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।
গাছের উচ্চতা, ডালপালা ও ছালের ধরন
-
গাছের গড় উচ্চতা ১৫ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে
-
ডালপালা ঘন এবং ছড়িয়ে থাকে যা ছায়াদানকারী হিসেবে উপকারী
-
ছাল সাধারণত বাদামি রঙের ও খসখসে প্রকৃতির
-
পরিণত গাছের ছাল থেকে সহজেই আঁশ ছাড়ানো যায়
এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে এটি রাস্তার পাশে ছায়া গাছ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
পাতা, ফুল ও ফলের বিবরণ
-
পাতাগুলো যৌগিক ও ত্রিপত্র বিশিষ্ট, অর্থাৎ প্রতিটি পাতায় তিনটি ছোট পাতার উপাদান থাকে
-
পাতার রঙ গাঢ় সবুজ এবং এটি গ্রীষ্মে ঘন হয়ে ওঠে
-
মার্চ-এপ্রিল মাসে ছোট ছোট হলুদাভ-সাদা ফুল ফোটে
-
ফুলের গুচ্ছ অনেকটা চেইনের মতো নিচের দিকে ঝুলে থাকে
-
ফল দেখতে অনেকটা ফ্ল্যাট শিমের মতো এবং এর ভিতরে ৪ থেকে ৬টি বীজ থাকে
ফল সাধারণত মে থেকে জুন মাসে পাকে এবং বীজ সংগ্রহ করে পুনরায় রোপণ করা যায়।
বৃদ্ধি ও বয়সকাল
চাম্বল গাছ খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে, যা বনায়নের জন্য আদর্শ। সঠিক যত্ন নিলে ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যেই কাঠ কাটার উপযোগী হয়ে ওঠে। গাছটি সাধারণত ৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, তবে কাঠের গুণগত মান ২০ বছর পর থেকে সর্বোচ্চ হয়। এই কারণে এটি দীর্ঘমেয়াদি বনজ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত।
চাম্বল গাছ কোথায় পাওয়া যায়?
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাম্বল গাছ স্বাভাবিকভাবে জন্মে। এটি একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছ যা বিশেষ করে নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, মাঠ ও সড়কের পাশে রোপণ করা হয়।
বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে বেশি জন্মে
বাংলাদেশের নিচের অঞ্চলগুলোতে চাম্বল গাছ বেশি পরিমাণে দেখা যায়:
-
রাজশাহী ও নাটোর অঞ্চল: খরা সহনশীল এলাকা হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়
-
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম: উঁচু জমি এবং ঢালু এলাকায় সফলভাবে জন্মে
-
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল: সামাজিক বনায়নের আওতায় ব্যাপকভাবে রোপণ করা হয়
-
কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল: এখানে ব্যক্তিগত বনায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়
এই গাছটি এমন এলাকাতেও ভালো জন্মায় যেখানে অন্যান্য গাছ ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে না।
দক্ষিণ এশিয়া ও বৈশ্বিক বিস্তৃতি
চাম্বল গাছ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে নিম্নলিখিত দেশে পাওয়া যায়:
-
ভারত: পাঞ্জাব, হরিয়ানা, বিহার, উত্তরপ্রদেশে ব্যাপকভাবে জন্মে
-
নেপাল: তেরাই অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বিস্তৃত
-
পাকিস্তান: সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে বাণিজ্যিকভাবে রোপণ করা হয়
-
আফগানিস্তান ও ইরান: সীমিতভাবে জন্মে
সম্প্রতি আফ্রিকার কিছু দেশেও (যেমন কেনিয়া ও উগান্ডা) বনায়নের উদ্দেশ্যে এই গাছ রোপণ শুরু হয়েছে।
চাম্বল গাছের জন্ম ও চাষ পদ্ধতি
চাম্বল গাছের চাষ বাংলাদেশে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ এটি যেমন দ্রুত বাড়ে, তেমনি কাঠের বাজারমূল্যও বেশি। তাছাড়া তুলনামূলকভাবে কম পরিচর্যায় এই গাছ ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
বীজ বা কাটিংয়ের মাধ্যমে রোপণ
চাম্বল গাছ সাধারণত দুইভাবে জন্মানো যায়:
- বীজের মাধ্যমে
বীজ সংগ্রহ করতে হয় পরিপক্ব ফল থেকে। শুকনো ফল ভেঙে ৪ থেকে ৬টি বীজ পাওয়া যায়।
বীজগুলো ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে বপন করলে চারা দ্রুত গজায়। - কাটিং বা শাখা কলমের মাধ্যমে
পরিণত গাছের ডাল কেটে নিয়ে রোপণ করলে থেকেও নতুন চারা গজাতে পারে। এই পদ্ধতিতে ফলন বেশি হয় এবং গাছ দ্রুত পরিণত হয়।
মাটি, জলবায়ু ও সেচ ব্যবস্থা
-
চাম্বল গাছ দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে
-
pH ৬.৫ থেকে ৭.৫ মাটি এই গাছের জন্য উপযুক্ত
-
অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হয় না, তবে চারার সময় সামান্য সেচ দিলে ভালো ফলন হয়
-
বাংলাদেশে মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময় রোপণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী
রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা
-
প্রতি চার মাস অন্তর আগাছা পরিষ্কার করা দরকার
-
বছরে একবার জৈব সার বা গোবর প্রয়োগ করলে গাছ দ্রুত বাড়ে
-
গাছ চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে ফাঁপা হয়ে কাঠ তৈরি শুরু করে
বাণিজ্যিক চাষে প্রতি একরে ২০০ থেকে ২৫০টি চারা রোপণ করা যায়, এবং সঠিক যত্নে প্রতি গাছ থেকে ৫০ কেজির বেশি কাঠ পাওয়া সম্ভব।
চাম্বল গাছের ব্যবহার
চাম্বল গাছ বহু ব্যবহারে সক্ষম। এটি শুধুমাত্র কাঠের জন্য নয়, এর পাতা, ছাল, বীজসহ নানা অংশ নানাভাবে ব্যবহৃত হয়।
কাঠের ব্যবহার (ফার্নিচার, জ্বালানি)
-
চাম্বল কাঠ খুবই মজবুত এবং টেকসই
-
আসবাবপত্র তৈরিতে এর ব্যবহার ব্যাপক
-
দরজা, জানালা, মেঝে, কাঠের তক্তা, কুলিং বোর্ড, চেয়ার-টেবিল প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়
-
কাঠের রং হালকা বাদামি থেকে গাঢ় হয়ে থাকে
-
কাঠ পোড়ালে উচ্চ তাপ উৎপন্ন করে, তাই এটি জ্বালানির জন্যও উপযোগী
-
বাজারে প্রতি ঘনফুট চাম্বল কাঠের দাম ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে
ওষুধি ব্যবহার (আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি)
চাম্বল গাছের ছাল ও পাতায় বিভিন্ন ঔষধি উপাদান রয়েছে:
-
ছাল গেঁটেবাত, পেটের অসুখ ও জ্বর কমাতে ব্যবহৃত হয়
-
পাতা ক্ষত সারাতে ও চর্মরোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়
-
চূর্ণ করে পান করলে হজমে সহায়তা করে
-
ইউনানি ও আয়ুর্বেদে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
পশুখাদ্য ও অন্যান্য গ্রামীণ প্রয়োগ
-
এর পাতা গরু, ছাগল ও ভেড়ার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়
-
পাতা শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায় এবং প্রয়োজনে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়
-
গ্রামে এই গাছের ডালপালা বঁড়শি, হাল, নাও বা গৃহস্থালির খুঁটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়
চাম্বল গাছের এই বহুমুখী ব্যবহার একে গ্রামীণ জীবনে অপরিহার্য করে তুলেছে।
আর পড়ুন: তমাল গাছ
চাম্বল গাছের উপকারিতা
চাম্বল গাছের উপকারিতা বহুমাত্রিক। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষা করে না, কৃষিজীবী পরিবারের জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যও বয়ে আনে।
স্বাস্থ্য উপকারিতা
-
গাছের ছাল ও পাতায় অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান আছে
-
চাম্বল ছালের রস জ্বর ও ঠান্ডাজনিত রোগে কার্যকর
-
চর্মরোগ, হাঁপানি, ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় উপকারী
-
ইউনানি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিতে একে রোগ প্রতিরোধক গাছ হিসেবে বিবেচনা করা হয়
আর্থিক গুরুত্ব
-
চাম্বল গাছের কাঠ স্থানীয় বাজার ও বিদেশে চাহিদাসম্পন্ন
-
গড়ে প্রতি গাছ থেকে ১০-১৫ হাজার টাকার কাঠ পাওয়া যায়
-
কৃষকরা একরপ্রতি ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন, যা অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি
-
সরকারি বনভূমি বা সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে রোপণ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব
কৃষিজীবী পরিবারের জন্য অবদান
-
ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ
-
গ্রামীণ নারীরা এর চারা উৎপাদন ও বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারেন
-
পশুখাদ্য ও জ্বালানি সংকটে এই গাছ উপকারী ভূমিকা রাখে
চাম্বল গাছের এইসব উপকারিতা বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
চাম্বল গাছ বনজ সম্পদ হিসেবে
চাম্বল গাছ শুধু একটি গাছ নয়, এটি একটি সম্পদ। বনজ সম্পদের অংশ হিসেবে এটি বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বন সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য
-
দ্রুতবর্ধনশীল হওয়ায় এটি সহজে বনভূমি পূরণ করতে সাহায্য করে
-
শুকনো অঞ্চল বা খালি জায়গায় বনায়নের জন্য আদর্শ
-
অন্যান্য গাছের তুলনায় এটি কম পরিচর্যায় টিকে থাকে, ফলে সামাজিক বনায়নে বেশি ব্যবহৃত হয়
-
গ্রামাঞ্চলে সামাজিক বনায়নের আওতায় বহু পরিবার এই গাছ রোপণ করে উপকৃত হচ্ছে
জৈব বৈচিত্র্য রক্ষা
-
এই গাছে অনেক পাখি, পোকা ও কীটের আবাস তৈরি হয়
-
মৌমাছির মধু সংগ্রহের জন্যও উপযুক্ত
-
এর পাতার নিচে ছায়া ও ঠান্ডা পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে অন্য উদ্ভিদ জন্মাতে সাহায্য করে
-
এইভাবে এটি একটি ছোটখাটো বাস্তুতন্ত্র (ecosystem) গড়ে তোলে
চাম্বল গাছের কারণে একটি অঞ্চল জীববৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
পরিবেশগত গুরুত্ব
আধুনিক পৃথিবীতে পরিবেশ রক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চাম্বল গাছ এই সমস্যার অনেকটা সমাধান দিতে পারে। এটি মৃত্তিকা, পানি ও বায়ুর গুণমান উন্নয়নে সহায়তা করে।
মৃত্তিকা ক্ষয় রোধে ভূমিকা
-
চাম্বল গাছের শিকড় গভীরভাবে মাটিতে প্রবেশ করে
-
এই শিকড় মাটিকে ধরে রাখে এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে
-
নদীর তীর, উঁচু ঢালু এলাকায় মাটি সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে
-
কৃষিজমি সংলগ্ন এলাকায় চাম্বল গাছ লাগানো হলে চাষযোগ্য মাটি রক্ষা পায়
কার্বন শোষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা
-
চাম্বল গাছ প্রতি বছর গড়ে ২০-২৫ কেজি পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে
-
এভাবে এটি বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখে
-
দীর্ঘস্থায়ী পত্রপল্লব ও ঘন শাখা-প্রশাখার কারণে এটি বায়ু পরিশোধক হিসেবেও কাজ করে
-
শহরের রাস্তায় ও শিল্পাঞ্চলে এই গাছ রোপণ করলে পরিবেশ দূষণ হ্রাস পায়
পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল
-
গাছটি উচ্চ এবং ঘন হওয়ায় পাখি বাসা তৈরি করে
-
কাঠবিড়ালী, মৌমাছি ও কিছু ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী এই গাছের উপর নির্ভরশীল
-
বনে এই গাছের উপস্থিতি একটি ছোট ইকোসিস্টেম তৈরি করে, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে
চাম্বল গাছের সাথে সম্পর্কিত লোকজ বিশ্বাস ও সংস্কৃতি
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চাম্বল গাছকে ঘিরে বহু লোকজ বিশ্বাস ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অনেক এলাকায় বিশ্বাস করা হয়, এই গাছ যেখানে জন্মায়, সেখানে বজ্রপাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম হয়। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, চাম্বল গাছের নিচে বসলে মন শান্ত হয় এবং মানসিক চাপ কমে যায়। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে গাছটির ছাল ও পাতাকে ওষুধি গাছের মর্যাদা দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে তাকে চাম্বল গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ সময় কাটাতে বলা হয়। আবার অনেক স্থানে এই গাছের ডালপালা ব্যবহার করে ছোটখাটো পূজার উপকরণ তৈরি করা হয়। যদিও এসব বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবে এটি স্পষ্ট যে গ্রামবাংলার জীবনে এই গাছ একটি আবেগ-সংলগ্ন অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে।
সামাজিক বনায়নে চাম্বল গাছের ভূমিকা
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যা পরিবেশ সংরক্ষণ এবং গ্রামের মানুষের জীবিকা উন্নয়নে সাহায্য করে। এই কর্মসূচির আওতায় এমন সব গাছ বেছে নেওয়া হয় যেগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, টেকসই এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। চাম্বল গাছ এ ক্ষেত্রে একটি আদর্শ উদাহরণ। এটি রোপণের তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই কাঠ সংগ্রহযোগ্য হয়ে ওঠে। সেইসাথে এর পরিচর্যা সহজ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। সরকারি ও বেসরকারি সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে এই গাছ ব্যাপকভাবে রোপণ করা হচ্ছে, বিশেষ করে রাস্তার পাশে, খাসজমিতে এবং বিদ্যালয় বা হাসপাতালের আঙিনায়। এর ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে, অন্যদিকে উপকারভোগীরা গাছ বিক্রি করে আর্থিক লাভও পাচ্ছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চাম্বল গাছ শুধু একটি বনজ সম্পদ নয়, বরং সামাজিক অর্থনীতিরও একটি শক্ত ভিত্তি।
বাজারে চাম্বল কাঠের চাহিদা ও মূল্য
চাম্বল গাছের কাঠ বাংলাদেশে কাঠবাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় আসবাবপত্র নির্মাতা, কাঠ ব্যবসায়ী এবং নির্মাণ খাতে এই কাঠের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাম্বল কাঠের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি মজবুত, সোজা ও তুলনামূলকভাবে হালকা। কাঠটি সহজে কাটাজোগ্য এবং পালিশ করলে আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করে। এই গুণাবলীর কারণে এটি দরজা, জানালা, তাক, খাট, আলমারি ইত্যাদি তৈরিতে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে চাম্বল কাঠের বাজারদর প্রতি ঘনফুট ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে, যা অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে। শহরের ফার্নিচার দোকানে এ কাঠের তৈরি পণ্যের দাম অন্য কাঠের তুলনায় বেশি হলেও টেকসই হওয়ায় ক্রেতারা এটি পছন্দ করেন। এইভাবে চাম্বল কাঠ কাঠবাজারে একটি লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে।
চাম্বল গাছ রোপণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
চাম্বল গাছের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সম্ভাবনা বিবেচনা করে সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বন বিভাগ বিভিন্ন সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে এই গাছ অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং কৃষকদের গাছ লাগাতে উৎসাহিত করছে। জেলা ও উপজেলা কৃষি অফিস থেকে মাঝে মাঝে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চারা বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও গাছ লাগানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং নারীদের সম্পৃক্ত করছে, যার মাধ্যমে তারা স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন। শহরাঞ্চলেও রাস্তার পাশে এবং পার্কে এই গাছ রোপণের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, যা পরিবেশ রক্ষা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। এইসব উদ্যোগের ফলে চাম্বল গাছের চাষ ও ব্যবহার সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশে বনজ সম্পদের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে।
চাম্বল গাছ রপ্তানি সম্ভাবনা
বাংলাদেশে উৎপাদিত চাম্বল গাছের কাঠ ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কিছু দেশে এই কাঠের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে যারা স্বল্পমূল্যে উন্নতমানের আসবাবপত্র তৈরি করতে চান, তাদের কাছে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে রপ্তানির পরিমাণ সীমিত হলেও ভবিষ্যতে কাঠ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে উঠলে এই গাছ বড় আকারে রপ্তানি করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন গাছের মান নিয়ন্ত্রণ, কাঠ সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং রপ্তানি সংক্রান্ত নীতিমালা। সরকার যদি কাঠ প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিতে উদ্যোগী হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে এবং কৃষকরাও এই শিল্পে লাভবান হবেন।
আর পড়ুন: পিপল গাছ
উপসংহার
বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষা, আর্থিক উন্নয়ন এবং বনজ সম্পদের পুনরুদ্ধারে চাম্বল গাছ এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করছে। এর কাঠ যেমন টেকসই, তেমনি বাজারে এর চাহিদাও ক্রমবর্ধমান। গাছটি সহজে জন্মায়, দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং রোগপ্রতিরোধী হওয়ায় এটি সাধারণ কৃষকদের জন্য লাভজনক। পাশাপাশি চাম্বল গাছের ওষুধি গুণাগুণ, পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার এবং লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে এর সম্পর্ক এটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় এর চাষ ও ব্যবহার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে রপ্তানির সুযোগ ও বন সংরক্ষণে ভূমিকার দিক থেকেও চাম্বল গাছ একটি সম্ভাবনাময় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। তাই এ গাছের চাষ ও রক্ষণাবেক্ষণ বাড়িয়ে আমরা একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা করতে পারব, অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও সহায়তা করতে পারব। চাম্বল গাছ শুধু একটি গাছ নয়, এটি একটি সম্পদ, একটি সম্ভাবনা এবং একটি শক্তিশালী ভবিষ্যতের দিশারী।