মানুষের জীবনে অক্সিজেন একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে এবং বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অক্সিজেনের অভাব মানুষের শরীর এবং মস্তিষ্কে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আপনি কি জানেন পৃথিবীর পরিবেশে অক্সিজেনের মূল উৎস হলো গাছ? গাছ ফটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন উৎপাদন করে।বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে গাছের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহুরে এলাকায় বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আর্টিকেলে আমরা জানব কোন গাছ বেশি অক্সিজেন দেয় ২৪ ঘন্টা অক্সিজেন উৎপাদন করে এমন গাছের তালিকা এবং গাছের উপকারী ভূমিকা।
কোন গাছ বেশি অক্সিজেন দেয়
গাছের অক্সিজেন উৎপাদন নির্ভর করে তাদের পাতা, গঠন এবং বয়সের উপর। বড় আকারের গাছ যেমন বটগাছ বা অশ্বত্থ গাছ বেশি অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এই গাছগুলোতে পাতার সংখ্যা বেশি থাকে যা ফটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
বাংলাদেশে বটগাছ এবং অশ্বত্থ গাছ গ্রামীণ এলাকায় বেশি দেখা যায়। এই গাছগুলোর শিকড় মাটি ধরে রাখে এবং বাতাসকে শুদ্ধ করে। গবেষণায় দেখা গেছে একটি পূর্ণবয়স্ক বটগাছ দিনে প্রায় ১০ জন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে।
আর পড়ুন: গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক
অন্য গাছগুলোও গুরুত্বপূর্ণ:
- নিম গাছ: এর শুধু অক্সিজেন উৎপাদন নয় এটি বায়ুকে দূষণমুক্ত করতেও সাহায্য করে।
- বাঁশ: একটি দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদ যা প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
কোন গাছ ২৪ ঘন্টা অক্সিজেন দেয়
প্রতিদিনের জীবনে আমরা সাধারণত মনে করি গাছ কেবল দিনের বেলায় অক্সিজেন সরবরাহ করে। তবে এমন কিছু গাছ আছে যারা রাতে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। এই গাছগুলো ক্রাসুলেসিয়ান অ্যাসিড মেটাবলিজম (CAM) পদ্ধতি ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে পাওয়া এমন গাছগুলো হলো:
- তুলসী: এটি শুধুমাত্র ২৪ ঘন্টা অক্সিজেন সরবরাহ করে না বরং এটি বাড়ির পরিবেশকে শুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে।
- অ্যালোভেরা: এটি ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালোভেরা রাতে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বায়ু থেকে টক্সিক উপাদান দূর করে।
- স্নেক প্ল্যান্ট: এই গাছটি কম আলোতেও বেঁচে থাকতে পারে এবং রাতের বেলায় অক্সিজেন সরবরাহ করে।
কোন গাছ সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে
গাছের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করা। এটি জলবায়ু পরিবর্তন কমানোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বড় বড় গাছ যেমন ম্যাঙ্গ্রোভ বা পাইন গাছ, প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম।
আর পড়ুন: স্পাইডার প্লান্ট এর যত্ন
বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
- ম্যাঙ্গ্রোভ গাছ: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া এই গাছগুলি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণে শীর্ষে। এছাড়া এটি উপকূলীয় ভূমি ক্ষয় রোধেও সাহায্য করে।
- পাইন গাছ: পাহাড়ি এলাকায় বেশি দেখা যায়। এই গাছগুলো বাতাস থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং পরিবেশকে শীতল রাখে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এই গাছগুলোর ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।
কোন গাছ সবচেয়ে বেশি উপকারী
গাছের উপকারিতা তাদের সরাসরি পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক প্রভাব দ্বারা নির্ধারিত হয়।
বটগাছ:
- এটি সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন সরবরাহকারী গাছগুলোর একটি।
- মাটি ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং ছায়া প্রদান করে।
তুলসী:
এর ঔষধি গুণাগুণ ব্যাপক। এটি বায়ু বিশুদ্ধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
নিম গাছ:
- এর পাতা ও শিকড় বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- এটি কীটপতঙ্গ দূর করতে সাহায্য করে এবং পরিবেশ শুদ্ধ করে।
অর্থনৈতিক দিক:
বাঁশ এবং সেগুন গাছ কাঠ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের কাঠের বাজারে এদের চাহিদা অত্যন্ত বেশি।
আর পড়ুন: কাঠের বলের দাম কত
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ গাছ
বাংলাদেশের উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুতে প্রচুর বৈচিত্র্যময় গাছ জন্মে যা দেশের বাস্তুতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক। পরিবেশ এবং মানুষের জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু গাছ হলো কাঁঠাল, আম ও বেল গাছ। কাঁঠাল দেশের জাতীয় ফল শুধুমাত্র পুষ্টি সরবরাহ করে না এটি প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেনও উৎপন্ন করে। বেল গাছ গ্রামীণ অঞ্চলে পবিত্র গাছ হিসেবে বিবেচিত এর ফল এবং পাতা ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ।
বাংলাদেশের শহর এলাকায় দ্রুত নগরায়নের ফলে গাছপালা কমে যাচ্ছে যা বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়াচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি এক হেক্টর মাটি ঢেকে থাকা বনে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড বার্ষিক শোষণ করার ক্ষমতা থাকে। এ কারণেই কাঁঠাল, আম ও নিম গাছের মতো স্থানীয় গাছগুলো বেশি রোপণ করা উচিত।
গাছ লাগানোর কৌশল এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সঠিক পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে গাছের ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত গাছ লাগানো প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, উপকূলীয় এলাকায় ম্যাঙ্গ্রোভ গাছ লাগানো উচিত যা উপকূল রক্ষা করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণে কার্যকর।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ গাছ লাগানোর পদ্ধতি এবং সঠিক যত্ন সম্পর্কে সচেতন নয়। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা দরকার যাতে স্থানীয় জনগণ গাছের প্রয়োজনীয়তা এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে পারে।
বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে গাছের ভূমিকা
গাছ পরিবেশে অক্সিজেন সরবরাহের পাশাপাশি বায়ু, পানি এবং মাটিকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ২২ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে। এছাড়া এটি বাতাস থেকে সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো দূষণকারী গ্যাস শোষণ করে যা মানুষের ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর।
গাছের পাতাগুলো সূক্ষ্ম ধূলিকণা শোষণ করে বায়ু বিশুদ্ধ করে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের মতো দূষিত এলাকায় বেশি সংখ্যক গাছ রোপণ করলে বায়ুর মান উন্নত হবে। গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রমাণ করে যে গাছহীন এলাকায় তাপমাত্রা গাছ-সমৃদ্ধ এলাকার তুলনায় ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।
আর পড়ুন: নয়নতারা ফুল গাছের পরিচর্যা
বাড়ির চারপাশে গাছ রোপণের উপকারিতা
বাড়ির চারপাশে গাছ রোপণ করা শুধু পরিবেশগত নয় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। গাছ বাড়ির তাপমাত্রা প্রাকৃতিকভাবে কমিয়ে দেয় ফলে বিদ্যুৎ খরচ হ্রাস পায়। গবেষণায় দেখা গেছে ছায়াযুক্ত এলাকায় ঘরের তাপমাত্রা ৫-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে।
বাড়ির আঙিনায় অ্যালোভেরা বা স্নেক প্ল্যান্টের মতো ছোট গাছ লাগালে ঘরের বায়ু বিশুদ্ধ থাকবে। এর ফলে অ্যাজমা বা এলার্জির মতো সমস্যা কমে। তুলসী গাছ বাড়ির চারপাশে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মশা তাড়াতে সাহায্য করে। এসব গাছ কম খরচে সুস্থ জীবনধারা বজায় রাখতে সহায়ক।
কীভাবে গাছের যত্ন নেওয়া যায়
গাছ লাগানোর পর সঠিক পরিচর্যা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি গাছ সঠিকভাবে বৃদ্ধি পেতে হলে তাকে সঠিক মাত্রায় পানি, আলো এবং পুষ্টি সরবরাহ করতে হয়। মাটির গুণাগুণ বুঝে সারের ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সার যেমন গোবর বা পচা পাতা বেশি কার্যকর।
গাছের রোগ এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত পরিদর্শন করা উচিত। গবেষণা প্রমাণ করে সঠিক যত্ন নেওয়া হলে গাছের বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং এর অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে গাছ লাগানোর পাশাপাশি কমিউনিটি গার্ডেন তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
আর পড়ুন: যৌবন শক্তি বৃদ্ধির ঔষধি গাছ
উপসংহার
পরিবেশ রক্ষায় গাছের অবদান অমূল্য। গাছ অক্সিজেন উৎপন্ন করে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে। এই আর্টিকেলে আমরা শিখেছি কোন গাছ বেশি অক্সিজেন দেয় ২৪ ঘন্টা অক্সিজেন সরবরাহকারী গাছগুলো কী কী এবং তারা পরিবেশে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি নাগরিকের উচিত বছরে অন্তত একটি গাছ লাগানো এবং সঠিকভাবে তার যত্ন নেওয়া। একটি গাছ শুধু পরিবেশ নয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে। আপনার চারপাশে আরও গাছ লাগান প্রকৃতিকে রক্ষা করুন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ পৃথিবী রেখে যান।
“প্রতিদিন একটি গাছ লাগান, সুন্দর পরিবেশ গড়ুন।”