কেরোসিন কাঠ (বন তিলা) একটি বিশেষ ধরণের কাঠ যা প্রচুর তাপ উৎপাদন ক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদী দহনক্ষমতার জন্য পরিচিত। এটি প্রাকৃতিকভাবে এমন গাছ থেকে আসে যা গাছের বাকল বা কাঠের মধ্য দিয়ে তেল নিঃসরণ করে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে কেরোসিন কাঠের উৎপত্তি হয়েছে। ২০২৪ সালে এই কাঠের দাম প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি ঘনফুট (বাংলাদেশের বাজারে) এবং ভারতে এর দাম প্রায় ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা প্রতি ঘনফুট হতে পারে।
এই কেরোসিন কাঠের উচ্চ জ্বলনক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদী তাপ উৎপাদনের ক্ষমতা এটিকে বাংলাদেশ ও ভারতের গ্রামের চুলার জ্বালানি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় করেছে। তাছাড়া এটি অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প এবং কুটির শিল্পে ব্যবহার করা হয়।
কেরোসিন কাঠ কি
কেরোসিন কাঠ মূলত এক ধরনের হার্ডউড যা বন তিলা গাছ থেকে প্রাপ্ত। গাছটির বৈশিষ্ট্য হলো এর কাঠ খুব ঘন এবং শক্ত। কাঠের মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক তেলের কারণে এটি অনেক বেশি সময় ধরে জ্বলতে সক্ষম হয়। গাছটি থেকে নির্গত তেলকে কখনও কখনও প্রাকৃতিক কেরোসিন হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয় কারণ এর কার্যক্ষমতা প্রচলিত কেরোসিনের মতো।
আর পড়ুন:ধুন্দল গাছের কাঠ
এই কাঠ ব্যবহারের মূল সুবিধা হলো এটি প্রচলিত কাঠের তুলনায় বেশি তাপ উৎপাদন করতে পারে এবং এটি দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বলতে পারে। গ্রামীণ এলাকা এবং সেই সব জায়গায়, যেখানে অন্যান্য আধুনিক জ্বালানি সহজলভ্য নয় কেরোসিন কাঠের চাহিদা ব্যাপক।
কেরোসিন কাঠের ব্যবহার
কেরোসিন কাঠ গ্রামীণ এলাকায় রান্নার কাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের পার্বত্য এলাকায়। যেহেতু এই কাঠ প্রচুর তাপ উৎপাদন করতে পারে এবং দ্রুত দহন করতে সক্ষম তাই এটি রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। কিছু জায়গায় এটি ঘর গরম করার জন্যও ব্যবহৃত হয়।
শিল্পক্ষেত্রে বিশেষত ক্ষুদ্র শিল্প এবং মৃৎশিল্পে এই কাঠ ব্যবহৃত হয় যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ন্ত্রিত তাপ উৎপাদন প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ ভারতের মিজোরামে অনেক কাঠ শিল্প প্রতিষ্ঠান এই কাঠ ব্যবহার করে। বাংলাদেশেও বিশেষত চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় ছোট ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে এই কাঠ ব্যবহার করা হয়।
কেরোসিন কাঠের উৎপাদন প্রক্রিয়া
কেরোসিন কাঠের গাছ বিশেষ করে বন তিলা গাছ যা Dipterocarpus প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বিশেষ কিছু অঞ্চলে জন্মায়। এই গাছের কাঠ খুব শক্ত এবং কাঠের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক তেল থাকে। উৎপাদনের জন্য গাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করা হয় এবং এর প্রাকৃতিক তেল আলাদা করার প্রক্রিয়া চালানো হয় না কারণ কাঠটি নিজে থেকেই উচ্চ দহনক্ষমতা সম্পন্ন থাকে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের বনভূমি থেকে এই গাছ কেটে স্থানীয় কাঠের বাজারে সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে ভারতের মেঘালয় ও মিজোরাম রাজ্যে কেরোসিন কাঠের ব্যাপক উৎপাদন হয়। তবে এই কাঠ সংগ্রহের প্রক্রিয়াতে পরিবেশের ওপর বেশ কিছু প্রভাব রয়েছে যেহেতু এই গাছগুলোর সংখ্যা সীমিত এবং এগুলো বনায়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়।
২০২৪ সালে কেরোসিন কাঠের দাম – একটি বিশ্লেষণ
২০২৪ সালে কেরোসিন কাঠের দাম বাংলাদেশ ও ভারতে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো উৎপাদন খরচ এবং বাজারে চাহিদার চাপ। বাংলাদেশে কেরোসিন কাঠের দাম বর্তমানে প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি ঘনফুট যেখানে ভারতে এই দামের রেঞ্জ ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা প্রতি ঘনফুট। তবে এই দাম বিভিন্ন অঞ্চলে আলাদা হতে পারে।
কেরোসিন কাঠের দামের ওপর প্রভাব ফেলে বাজারের চাহিদা, স্থানীয় সরবরাহের পরিমাণ এবং পরিবহন খরচ। বিশেষ করে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য অঞ্চলের বাজারে এর দাম তুলনামূলক বেশি কারণ সেখানকার বাজারে কাঠ সহজলভ্য নয়। ভারতেও পার্বত্য এলাকাগুলোতে এর চাহিদা ও দাম বেশি।
বিভিন্ন স্থানে কেরোসিন কাঠের দাম
বাংলাদেশের ভেতরে কেরোসিন কাঠের দাম বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন হতে পারে। বিশেষত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এর দাম একটু বেশি হয়ে থাকে কারণ সেখানে উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন কম এবং পরিবহন খরচও বেশি। ঢাকায় এই কাঠের দাম প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি ঘনফুটের মতো হতে পারে কারণ রাজধানীতে সরবরাহ চেইন তুলনামূলক জটিল।
ভারতে মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যে এই কাঠের দাম ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা প্রতি ঘনফুটের মধ্যে রয়েছে। এছাড়াও ভারতে কিছু অঞ্চল বিশেষত উত্তর-পূর্বাঞ্চল এই কাঠের সরবরাহ এবং চাহিদা অনুযায়ী দাম ভিন্ন হতে পারে।
কেরোসিন কাঠের মূল্যের ওপর প্রভাবক
কেরোসিন কাঠের দাম বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান প্রভাবকগুলো নিম্নরূপ:
- চাহিদা এবং সরবরাহ: বাজারে কেরোসিন কাঠের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য অনেক সময় প্রভাব ফেলে। যদি কোনও অঞ্চলে কেরোসিন কাঠের চাহিদা বেড়ে যায় এবং সরবরাহ কম থাকে তবে তার দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে চাহিদা বেশি হলেও কাঠের সরবরাহ কম থাকে যার ফলে দাম বেশি হয়।
- পরিবহন খরচ: কেরোসিন কাঠ সাধারণত দূরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল থেকে সরবরাহ করা হয়। যেমন বাংলাদেশে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল এবং ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে। কাঠ সংগ্রহের পর তা শহরের বাজারগুলোতে পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়। এই পরিবহন খরচ বিশেষ করে পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম বাড়লে কেরোসিন কাঠের মূল্যও বেড়ে যায়।
- কর এবং শুল্ক: বাংলাদেশ ও ভারতে কেরোসিন কাঠের ওপর স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কর ও শুল্ক আরোপিত হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবহন কর স্থানীয় বাজারের শুল্ক এবং ভ্যাট। বিশেষত যখন শুল্ক বাড়ানো হয় বা কোনও নতুন কর আরোপ করা হয় তখন এর প্রভাব সরাসরি কাঠের দামের ওপর পড়ে।
- মৌসুমভিত্তিক চাহিদা: শীতকালে বা শুষ্ক মৌসুমে জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যায়। যেহেতু কেরোসিন কাঠ বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় ঘর গরম করার জন্য ব্যবহৃত হয় তাই শীতকালে এর দাম তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। অন্যদিকে বর্ষা বা গরমকালে চাহিদা কম থাকে যার ফলে দাম কিছুটা হ্রাস পায়।
আর পড়ুন:পাউলোনিয়া গাছের চারার দাম
কেরোসিন কাঠ কোথায় পাওয়া যায়
বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে কেরোসিন কাঠ পাওয়া যায়। নিচে কিছু প্রধান স্থানের উল্লেখ করা হলো:
- বাংলাদেশে: বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হলো কেরোসিন কাঠের প্রধান উৎস। এই অঞ্চল থেকে কাঠটি ঢাকার বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। চট্টগ্রামের বাজারে কেরোসিন কাঠের চাহিদা বেশি হওয়ায় এর দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মতো বড় শহরগুলোতেও এই কাঠ পাওয়া যায় যেখানে কাঠের দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি ঘনফুট হতে পারে।
- ভারতে: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে মেঘালয়, মিজোরাম, আসাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যে কেরোসিন কাঠ পাওয়া যায়। এই এলাকাগুলিতে বন তিলা গাছ ব্যাপকভাবে জন্মায় এবং এখান থেকে স্থানীয় ও দেশের অন্যান্য রাজ্যে কাঠ সরবরাহ করা হয়। মিজোরাম ও ত্রিপুরায় এই কাঠ ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা প্রতি ঘনফুটের মধ্যে বিক্রি হয়। এছাড়া কিছু অনলাইন বিক্রেতাও কেরোসিন কাঠ বিক্রি করে যা সরাসরি ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়।
কেরোসিন কাঠের দাম বনাম অন্যান্য জ্বালানি উপকরণের দাম
কেরোসিন কাঠের দাম তুলনামূলকভাবে অন্যান্য প্রচলিত জ্বালানি উপকরণের চেয়ে কিছুটা বেশি হতে পারে তবে এর কার্যকারিতা এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার এটিকে কিছু ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী করে তুলতে পারে। নিচে কেরোসিন কাঠের সাথে অন্যান্য জ্বালানি উপকরণের মূল্যের তুলনা করা হলো:
- কাঠ: প্রচলিত কাঠের দাম সাধারণত ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা প্রতি ঘনফুটের মধ্যে হয় যা কেরোসিন কাঠের তুলনায় কিছুটা কম। তবে প্রচলিত কাঠের তুলনায় কেরোসিন কাঠ বেশি কার্যকর এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে জ্বলে।
- কয়লা: বাংলাদেশে কয়লার দাম প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা প্রতি টন যেখানে কেরোসিন কাঠের জ্বলনক্ষমতা আরও বেশি। তবে কয়লা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে যা কেরোসিন কাঠকে একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে তুলে ধরে।
- গ্যাস: প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম তুলনামূলকভাবে কম হলেও এটি সব জায়গায় সহজলভ্য নয়। অনেক গ্রামীণ এলাকায় গ্যাস সরবরাহের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেখানে কেরোসিন কাঠ একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের কেরোসিন কাঠের দাম পার্থক্য
বাংলাদেশ ও ভারতের স্থানীয় বাজারে কেরোসিন কাঠের দাম কিছুটা ভিন্ন। যেমন বাংলাদেশে কেরোসিন কাঠের দাম ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি ঘনফুট হতে পারে। যেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই কাঠের দাম ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা প্রতি ঘনফুট হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কেরোসিন কাঠের তেমন চাহিদা নেই কারণ এটি মূলত স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও ব্যবহারিত হয়। তবে কিছু দেশ যেমন মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডেও কেরোসিন কাঠের কিছু উৎপাদন দেখা যায় যেখানে এটি স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। বৈশ্বিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে কেরোসিন কাঠের দামেও কিছুটা পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
কেরোসিন কাঠের বাজারে সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ
কেরোসিন কাঠের বাজার ক্রমাগত সম্প্রসারণের দিকে যাচ্ছে বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্ন আয়ের পরিবার এবং ছোট শিল্পগুলোতে এর চাহিদা বেশি। কারণ এটি দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি হিসেবে কার্যকর। তবে এই কাঠের সংগ্রহ ও পরিবহন বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
- সম্ভাবনা: গ্রামীণ এলাকায় সহজলভ্যতা এবং দাম সাশ্রয়ী হওয়ায় কেরোসিন কাঠের বাজার সম্প্রসারিত হতে পারে।
কাঠের পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্য এবং দীর্ঘস্থায়ী তাপ উৎপাদন ক্ষমতা এটিকে বাজারে টিকিয়ে রাখবে। - চ্যালেঞ্জ: বন উজাড় এবং পরিবেশগত প্রভাবের কারণে কেরোসিন কাঠের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় বাজারে সরবরাহ কম হলে এর দাম বাড়তে পারে।
আর পড়ুন:ভিয়েতনাম নারিকেল গাছের দাম
উপসংহার এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
কেরোসিন কাঠের ভবিষ্যৎ বাজারের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে এটি বিশেষত গ্রামীণ এবং শিল্প খাতে টিকে থাকবে। এর কার্যক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদী দহনক্ষমতা এবং সাশ্রয়ী দাম এটিকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলছে। যদিও উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে এর দাম বৃদ্ধি পেতে পারে, তবুও কেরোসিন কাঠ স্থানীয় বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকবে।
আমরা আশা করি যে ভবিষ্যতে এই কাঠের ব্যবহারের নতুন পদ্ধতি ও আরও কার্যকরী উৎপাদন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করা হবে যা বাজারে এর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক হবে।