গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক – পরিবেশ ও ভবিষ্যতের বিপদ

গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক

গাছ প্রকৃতির সেই উপাদান যা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ও মানবজাতির টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু অক্সিজেন সরবরাহই করে না বরং কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ভূমিক্ষয় রোধ এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে পরিবেশকে সুস্থ রাখে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নগরায়ণ, কৃষি সম্প্রসারণ এবং শিল্পায়নের জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ ইতোমধ্যেই ১৪% এর নিচে নেমে এসেছে, যা পরিবেশের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি।
গাছ কাটার ফলে শুধু পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে না পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে গাছ কাটার প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা গাছ কাটার বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব যা আপনাকে এই বিষয়ে সচেতন হতে সাহায্য করবে।

গাছ কাটার সংজ্ঞা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

গাছ কাটার সংজ্ঞা এবং উদ্দেশ্য

গাছ কাটাকে মূলত বনাঞ্চল বা গাছপালাকে কেটে ফেলার প্রক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটি নগরায়ণ, কৃষিকাজ, শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ এবং জ্বালানি কাঠের জন্য প্রধানত করা হয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পিত গাছ কাটা পরিবেশের ক্ষতি কমাতে সহায়তা করে তবে নির্বিচারে গাছ কাটা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে নগরায়ণের জন্য ভূমির চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে নতুন রাস্তা, ভবন এবং কারখানা তৈরি করতে গিয়ে বনাঞ্চল এবং সবুজ জমি উজাড় করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড় কেটে এবং সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস করে এসব উন্নয়নমূলক কাজ করা হচ্ছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২.১% হারে বন উজাড় হচ্ছে। এর ফলে বনজ সম্পদ যেমন কমে যাচ্ছে তেমনই বায়ু ও পানির গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।

আর পড়ন: আগর কাঠের দাম ২০২৪ 

বাংলাদেশে গাছ কাটার বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে বনাঞ্চলের মোট আয়তন বর্তমানে মাত্র ১৩.২% (FAO, ২০২০)। এটি দেশের প্রয়োজনীয় বনাঞ্চলের তুলনায় অত্যন্ত কম। সুন্দরবন যা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে কাজ করে সেখানে অবৈধ গাছ কাটা এবং শিল্পের সম্প্রসারণের কারণে ধ্বংসের মুখে।
চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় বন উজাড়ের হার সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে গাছ কাটা মূলত কাঠের চাহিদা পূরণ এবং কৃষিজমি সম্প্রসারণের জন্য হয়ে থাকে। এর ফলে ওই এলাকায় ভূমিধস এবং বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া ভূমিধসে প্রায় ১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন যা মূলত গাছ কাটার কারণে পাহাড়ের মাটি দুর্বল হয়ে পড়ার ফল।
বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে বনজ সম্পদ হারানোর আর্থিক ক্ষতি প্রতি বছর ১.৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই ক্ষতি কেবল বনজ পণ্যের অভাবেই নয় বরং মাটির গুণগত মান হ্রাস, বন্যা এবং কৃষির ওপর পড়া প্রভাবের মাধ্যমেও ঘটে।

বিশ্বব্যাপী গাছ কাটার অবস্থা

বিশ্বজুড়ে বন উজাড়ের হার আশঙ্কাজনক। FAO-এর ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমান বন ধ্বংস হচ্ছে। অ্যামাজন রেইনফরেস্ট যা পৃথিবীর “ফুসফুস” হিসেবে পরিচিত সেখানে প্রতি বছর ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর বন উজাড় হচ্ছে। এই গাছ কাটার প্রধান কারণ হলো গবাদিপশু পালনের জন্য জমি তৈরি এবং সয়াবিনের মতো ফসল চাষ।
বাংলাদেশ যা আগে বনসম্পদে সমৃদ্ধ ছিল বর্তমানে গাছ কাটার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এখানে গাছ কাটার হার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

গাছ কাটা উচিত নয় কেন – গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক

গাছ কাটা পরিবেশ এবং মানুষের জীবনে নানাভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে না বরং আর্থিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যার সৃষ্টি করে। নিচে এই বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

পরিবেশের ওপর প্রভাব

গাছ পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। গাছ কাটার ফলে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় যা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।

বায়ুদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন:

গাছ কাটা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে গাছ কাটার কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.২°C বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে এই প্রভাব আরও তীব্র। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন বন্যা গাছ কাটার সঙ্গে সম্পর্কিত।

ভূমিক্ষয় এবং মাটির গুণগত মান:

গাছের শেকড় মাটি ধরে রাখে এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে। কিন্তু যখন গাছ কাটা হয় তখন মাটি আলগা হয়ে যায় এবং বৃষ্টির পানির সঙ্গে ধুয়ে যায়। এর ফলে কৃষিজমি উর্বরতা হারায়। চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলে ভূমিক্ষয়ের কারণে প্রায় ৫-১০% কৃষিজমি ইতোমধ্যে অচাষযোগ্য হয়ে গেছে।

জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব

গাছপালা শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয় প্রাণীকুলেরও আশ্রয়স্থল। একটি বড় গাছ ১,০০০টিরও বেশি প্রাণীর বাসস্থান হতে পারে। কিন্তু গাছ কাটার ফলে এই বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যায়।

বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস:

সুন্দরবনে বাঘ এবং হরিণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস। ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা মাত্র ১০৬-এ নেমে এসেছে।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট:

গাছ কাটার ফলে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যায়। উদাহরণস্বরূপ, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীরা যদি খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য গাছ না পায় তবে তারা বিলুপ্তির মুখে পড়বে। এটি পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্টের পাশাপাশি কৃষিকাজে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণেও প্রভাব ফেলে।

আর পড়ন: যৌবন শক্তি বৃদ্ধির ঔষধি গাছ

গাছ না থাকলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কেমন হবে

গাছ পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের প্রাণশক্তি। এটি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে আবহাওয়ার ভারসাম্য বজায় রাখে এবং খাদ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। তবে যদি নির্বিচারে গাছ কাটা চলতে থাকে এবং গাছ রোপণের হার বাড়ানো না হয় তবে ভবিষ্যতে পৃথিবী হবে মানব ও প্রাণীর বসবাসের জন্য এক বিপর্যস্ত স্থান।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

গাছ মাটি ধরে রাখে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু গাছ না থাকলে ভূমিধস, বন্যা এবং মরুকরণ বৃদ্ধি পাবে।

ভূমিধস এবং মাটিক্ষয়:

চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় গাছ কাটার ফলে ভূমিধসের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গাছের শেকড় মাটি ধরে রাখে এবং ভারসাম্য বজায় রাখে। গাছ না থাকায় বৃষ্টি হলে মাটি আলগা হয়ে যায় এবং ভূমিধস হয়। এই ধরনের দুর্যোগ শুধু সম্পদের ক্ষতি নয়, প্রাণহানির কারণও হয়ে দাঁড়ায়।

জলোচ্ছ্বাস এবং সাইক্লোনের তীব্রতা:

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছ ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা কমায়। কিন্তু সুন্দরবনের একটি বড় অংশ গাছ কাটার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০২০ সালের আম্পানের সময় গাছের অভাবে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল।

খাদ্য নিরাপত্তার সংকট

গাছ পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এগুলো কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। গাছ না থাকলে ভূমি উর্বরতা হারাবে এবং খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশে বর্ষাকালে নদীর তলদেশে পলি জমার ফলে কৃষিজমির উর্বরতা কমে যায়। এটি গাছ কাটার একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব। FAO-এর রিপোর্ট অনুযায়ী যদি গাছ কাটা না কমানো হয় তবে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা ৩০% কমে যাবে।

মানুষের বসবাসের অযোগ্য পরিবেশ

গাছ পৃথিবীর প্রাকৃতিক শীতলীকরণ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। গাছপালার অভাবে শহরের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে বাংলাদেশে। ঢাকা শহরে ২০১৫-২০২২ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিটস্ট্রোক এবং অন্যান্য তাপ-সম্পর্কিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। এছাড়া পানির স্তর নেমে যাওয়ার ফলে গ্রামীণ অঞ্চলে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

গাছ কাটা বন্ধ করার উপায় – গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক

গাছ কাটার ক্ষতিকর প্রভাব রোধে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র গাছ কাটা বন্ধ করলেই হবে না পাশাপাশি পুনঃবনায়ন এবং গাছ রোপণের হার বাড়ানো জরুরি।

সরকারি নীতি এবং আইন

বাংলাদেশ সরকার বন সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে। তবে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

বন সংরক্ষণ আইন:
১৯৭৩ সালে প্রণীত “বাংলাদেশ বন আইন” বনাঞ্চল সংরক্ষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কিন্তু অবৈধ কাঠ সংগ্রহ এবং জমি দখলের কারণে এটি বাস্তবে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। বন রক্ষার জন্য আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

পরিকল্পিত নগরায়ণ:
বাংলাদেশে নগরায়ণ বাড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেটে ফেলার প্রবণতা রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে গাছ কাটার পরিবর্তে ছাদবাগান এবং পরিকল্পিত স্থাপত্যের প্রচলন করতে হবে।

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি

সাধারণ মানুষকে গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা অপরিহার্য।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক প্রচারণা:

বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ রক্ষার ওপর নিয়মিত প্রচারাভিযান চালানো যেতে পারে। এতে শিশুদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই পরিবেশবান্ধব মনোভাব গড়ে উঠবে।

সামাজিক মিডিয়ার ভূমিকা:

সামাজিক মিডিয়ায় তথ্যচিত্র এবং পোস্টের মাধ্যমে গাছ সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই মাধ্যমের শক্তি ব্যবহার করে দ্রুত জনমত গঠন করা সম্ভব।

পুনঃবনায়ন এবং বৃক্ষরোপণ

গাছ কাটার কারণে ধ্বংস হওয়া বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে হবে।

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি:

বাংলাদেশে “বৃক্ষরোপণ অভিযান” নামে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে এটি একটি বড় সফলতা হতে পারে।

বন পুনর্গঠন:

বিশেষ করে সুন্দরবন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন পুনর্গঠনের জন্য বড় পরিসরে প্রকল্প নেওয়া উচিত।

আর পড়ন:  ডায়াবেটিস গাছের দাম ২০২৪

গাছ কাটার বিরুদ্ধে ইতিবাচক উদাহরণ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং বাংলাদেশে গাছ সংরক্ষণের জন্য নেওয়া সফল উদ্যোগগুলোর উদাহরণ আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। এই ধরনের উদাহরণ অনুসরণ করলে বনাঞ্চল সংরক্ষণ এবং পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশে গাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ

সুন্দরবন সংরক্ষণ প্রকল্প:

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। UNEP এবং বাংলাদেশ সরকার একত্রে সুন্দরবন সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের আওতায় গাছ লাগানো, অবৈধ কাঠ সংগ্রহ রোধ এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা হচ্ছে।

সামাজিক বনায়ন:
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বেশ সফল। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ মানুষ বনাঞ্চল তৈরি এবং গাছ রোপণে অংশ নিচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন বনজ সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি আর্থিকভাবে মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সফলতা – গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক

কস্টারিকার বন সংরক্ষণ মডেল:
কস্টারিকা পৃথিবীর অন্যতম সফল বন সংরক্ষণকারী দেশ। সেখানে বন উজাড়ের হার শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের বন সংরক্ষণে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে এই সফলতা অর্জন করা হয়েছে।

নরওয়ের বন রক্ষা প্রকল্প:
নরওয়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান বন সংরক্ষণকারী দেশ। তাদের কার্বন শোষণ বাড়ানোর প্রকল্পের অংশ হিসেবে গাছ রোপণ এবং বন সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

গাছ কাটা বন্ধ করতে শিক্ষার ভূমিকা

গাছ সংরক্ষণ এবং বন উজাড় রোধে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষা মানুষের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে এবং তাদের পরিবেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।

প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা

পরিবেশ শিক্ষা:

শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত জ্ঞান প্রদান করা হলে তারা ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব আচরণে অভ্যস্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন বিদ্যালয়ে “পরিবেশ ক্লাব” গঠন করা যেতে পারে যেখানে গাছ রোপণ, পরিচর্যা এবং গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা হবে।

প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম:

শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করার জন্য প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। এতে তারা সরাসরি পরিবেশের গুরুত্ব অনুভব করতে পারবে।

 উচ্চশিক্ষায় গবেষণা

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গাছ সংরক্ষণ এবং পরিবেশের উপর গবেষণা উৎসাহিত করতে হবে।

পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ:

বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ চালু রয়েছে। এই বিভাগগুলোতে গবেষণার জন্য আরও বেশি বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ সংরক্ষণ এবং বনজসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে গবেষণাগুলো উল্লেখযোগ্য।

গাছ কাটার অর্থনৈতিক প্রভাব

গাছ কাটা শুধু পরিবেশের জন্য নয় অর্থনীতির জন্যও বিপর্যয়কর।

 বনজসম্পদের হ্রাস
বাংলাদেশের বনজ সম্পদ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাঠ, ফল, হার্বাল ওষুধ এবং অন্যান্য বনজ সম্পদের সরবরাহ কমে গেলে দেশের অর্থনীতি বিপদে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রামের বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার ফলে স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।

পর্যটন খাতে ক্ষতি
বাংলাদেশের পর্যটন খাতের একটি বড় অংশ নির্ভর করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপর। গাছ কাটার ফলে সুন্দরবন ও পাহাড়ি এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যা পর্যটকদের আকর্ষণ কমিয়ে দিচ্ছে।

স্থানীয় জীবিকা হুমকির মুখে
বনাঞ্চলের আশপাশের মানুষের জীবনযাত্রা গাছের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয়রা বন থেকে কাঠ, মধু, ওষুধি গাছ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। গাছ কাটা তাদের আয়ের উৎস ধ্বংস করছে।

গাছ কাটা থেকে সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত প্রভাব

গাছ কাটা শুধু পরিবেশ বা অর্থনীতি নয় সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত বিষয়েও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
গাছ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। গাছ কাটা হলে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং বায়ুদূষণ বাড়ে। ঢাকার মতো শহরে গাছপালা কম থাকার কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বেড়ে গেছে।
গাছের অভাবে শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। WHO-এর মতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তাপজনিত রোগ বিশেষত হিটস্ট্রোকের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বনাঞ্চল উজাড় হলে স্থানীয় বাসিন্দারা জীবিকা হারিয়ে শহরে অভিবাসন করতে বাধ্য হয়। এর ফলে শহরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ পড়ে।
বনাঞ্চল উজাড়ের কারণে জমি নিয়ে বিরোধ এবং সংঘাত বেড়েছে। বিশেষত পার্বত্য অঞ্চলে এই সমস্যা তীব্র।

গাছ কাটা রোধে প্রযুক্তির ভূমিকা – গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক

গাছ সংরক্ষণ এবং বন উজাড় প্রতিরোধে প্রযুক্তি ব্যবহার একটি অত্যাধুনিক সমাধান হতে পারে।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গাছ কাটার হার পর্যবেক্ষণ এবং অবৈধ কাঠ সংগ্রহ শনাক্ত করা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে ভারতের বন বিভাগ স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে বনাঞ্চল পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বনাঞ্চলের গভীর এলাকায় ড্রোন ব্যবহার করে নজরদারি চালানো সম্ভব। এতে অবৈধ কাঠ সংগ্রহকারীদের দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে।

আর পড়ন:  বাবলা গাছ 

উপসংহার – গাছ কাটার ক্ষতিকর দিক

গাছ কাটা রোধে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন। গাছ কাটা বন্ধ করতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

  • প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় গাছ লাগানো এবং পরিচর্যার মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারে।
  • সমাজের নেতারা এবং স্থানীয় প্রশাসন গাছ সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝাতে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।

একটি সবুজ ও টেকসই বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য গাছ সংরক্ষণ অপরিহার্য। এই প্রচেষ্টায় আমরা একসঙ্গে কাজ করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *