গাছ আমাদের পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবলমাত্র অক্সিজেন সরবরাহ করে না বরং জীববৈচিত্র্য রক্ষা, মাটি সংরক্ষণ এবং জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান বিশ্বের দ্রুত নগরায়ন এবং বনভূমি উজাড়ের কারণে দ্রুতবর্ধনশীল গাছের চাষ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বনায়ন, কৃষি এবং শৌখিন বাগান ব্যবস্থায় দ্রুতবর্ধনশীল গাছ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। এমন গাছগুলো স্বল্প সময়ে পরিণত হয় এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল সরবরাহ করে। এ আর্টিকেলে আমরা জানতে চেষ্টা করব কোন কোন গাছ তাড়াতাড়ি বড় হয় এবং এগুলো চাষাবাদের উপযুক্ত পদ্ধতি কী।
দ্রুতবর্ধনশীল গাছের বৈশিষ্ট্য
দ্রুতবর্ধনশীল গাছ এমন গাছ যা স্বল্প সময়ে বৃদ্ধি লাভ করে এবং কাঙ্ক্ষিত আকার বা ফলাফল প্রদান করে। এদের বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে চাষাবাদ পদ্ধতি নির্ধারণ করা সহজ হয়।
আর পড়ুন: লাকি বাম্বু গাছের পরিচর্যা
দ্রুতবর্ধনশীল গাছের সংজ্ঞা
দ্রুতবর্ধনশীল গাছ বলতে এমন গাছকে বোঝায়, যেগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিপূর্ণ আকারে পৌঁছে যায়। এগুলো কাঠ, ফল, ছায়া অথবা পরিবেশগত সুবিধা প্রদানে কার্যকর। যেমন ইউক্যালিপটাস এবং কলা গাছ মাত্র কয়েক মাস থেকে এক বছরের মধ্যে ভালো ফলন দেয়।
বৃদ্ধি প্রভাবিতকারী প্রধান উপাদানসমূহ
গাছের বৃদ্ধি দ্রুত হওয়ার পেছনে কিছু নির্দিষ্ট উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- মাটি:দোআঁশ ও বেলে মাটি দ্রুতবর্ধনশীল গাছের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। মাটির পুষ্টিগুণ এবং সঠিক পানি ধারণ ক্ষমতা গাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
- পানি:নিয়মিত সেচ গাছের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অতিরিক্ত পানি অথবা পানির অভাব গাছের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
- আলো:গাছের পুষ্টি শোষণ প্রক্রিয়া সূর্যালোকের উপর নির্ভর করে। যথেষ্ট আলো সরবরাহ করলে গাছ দ্রুত পরিণত হয়।
- সারের প্রভাব:গাছের বৃদ্ধির জন্য অর্গানিক এবং ইনঅর্গানিক সার অপরিহার্য। যেমন ইউরিয়া এবং ফসফেট সার দ্রুতবর্ধনশীল গাছের জন্য কার্যকর।
পরিবেশগত প্রভাব এবং উপকারিতা
দ্রুতবর্ধনশীল গাছ পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরা বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি, ভূমিক্ষয় রোধ এবং মাটির পুষ্টি সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখে।
কোন গাছ তাড়াতাড়ি বড় হয়
বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং মাটির গুণমান বিবেচনায় কিছু নির্দিষ্ট গাছ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এগুলোকে বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় যেমন কাঠ, ফল, ছায়া এবং শৌখিনতার জন্য।
বনায়নে ব্যবহৃত গাছ
- ইউক্যালিপটাস গাছ: ইউক্যালিপটাস একটি দ্রুতবর্ধনশীল গাছ যা সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পরিপক্ব হয়ে যায়। এ গাছটি কাঠ এবং জ্বালানির জন্য চাষ করা হয়। এর কাঠ ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং ফার্নিচার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। প্রতি ঘনফুট ইউক্যালিপটাস কাঠের দাম বাংলাদেশে প্রায় ৬০০-৮০০ টাকা।
- আকাশমণি গাছ: আকাশমণি গাছ বনায়নে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং প্রায় তিন থেকে চার বছরের মধ্যে কাঠ কাটার উপযোগী হয়। এর কাঠ সাধারণত ফার্নিচার ও নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়। এর ঘনফুট কাঠের বাজার মূল্য প্রায় ৪৫০-৬৫০ টাকা।
- বকাইন গাছ:বকাইন গাছ ছায়া প্রদান এবং কাঠের জন্য চাষ করা হয়। এটি চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পূর্ণ আকার ধারণ করে। এর কাঠ সাধারণত বাড়ির আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
শৌখিন বা বাগানের গাছ
- কৃষ্ণচূড়া গাছ: বাংলাদেশে কৃষ্ণচূড়া একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় শৌখিন গাছ। এটি ছায়া এবং ফুলের জন্য বিখ্যাত। তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এটি পূর্ণ আকার ধারণ করে এবং গ্রীষ্মকালে রঙিন ফুল ফোটে।
- রাধাচূড়া গাছ:রাধাচূড়া গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এক থেকে দুই বছরের মধ্যেই ফুল দেয়। এটি সাধারণত রাস্তার পাশে এবং পার্কে রোপণ করা হয়।
- জারুল গাছ: জারুল গাছ রঙিন ফুলের জন্য বিখ্যাত। এটি সাধারণত দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পূর্ণ আকারে পৌঁছে যায়। এর ফুল শোভা বাড়ায় এবং এটি ছায়া প্রদানের জন্যও উপযোগী।
আর পড়ুন: বারোমাসি আম গাছের পরিচর্যা
ফলজ গাছ
- কলা গাছ: বাংলাদেশে কলা একটি অত্যন্ত পরিচিত ফল। কলা গাছ মাত্র ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ফল দিতে শুরু করে। এর দ্রুত বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা এটি কৃষকদের জন্য লাভজনক করে তোলে। এক থোকা কলার বাজার মূল্য প্রায় ১০০-২০০ টাকা।
- পেঁপে গাছ: পেঁপে একটি পুষ্টিকর ফল যা সাধারণত এক বছরের মধ্যে ফল দেয়। এটি বাড়ির বাগান এবং বাণিজ্যিক চাষে জনপ্রিয়। এক কেজি পেঁপের দাম বাংলাদেশে প্রায় ৪০-৬০ টাকা।
- আম গাছ (গুটি আম): গুটি আমের জাত দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল দেয়। এর ফলন এবং স্বাদ এটিকে স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
ঔষধি গাছ
- নিম গাছ: নিম একটি বহুবিধ উপকারিতাসম্পন্ন ঔষধি গাছ। এটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
- অশ্বগন্ধা গাছ: অশ্বগন্ধা স্বল্প সময়ের মধ্যে বৃদ্ধি পায় এবং এটি ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
- তুলসী গাছ: তুলসী গাছ ঘরে ঘরে পরিচিত। এটি খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
কোন ফুল গাছ তাড়াতাড়ি বড় হয়
ফুলগাছ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাগান বা পরিবেশকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। বাংলাদেশে কিছু নির্দিষ্ট ফুলগাছ দ্রুত বেড়ে ওঠার জন্য জনপ্রিয়। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ সহজ এবং বিভিন্ন ঋতুতে ফুল ফোটাতে সক্ষম।
- গাঁদা ফুল গাছ: গাঁদা ফুল গাছ অত্যন্ত দ্রুতবর্ধনশীল এবং সাধারণত দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই ফুল ফোটে। এটি দোআঁশ ও বেলে মাটিতে ভালোভাবে জন্মে। গাঁদা ফুল বিভিন্ন উৎসব এবং পূজায় ব্যবহৃত হয়। এক কেজি গাঁদা ফুলের বাজার মূল্য প্রায় ৬০-১০০ টাকা।
- সূর্যমুখী ফুল গাছ: সূর্যমুখী ফুল গাছ চাষ খুবই সহজ এবং এটি মাত্র তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ফুল ফোটাতে সক্ষম। সূর্যমুখী চাষ বাণিজ্যিকভাবে তেল উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এক কেজি সূর্যমুখী ফুলের বীজের দাম প্রায় ৩০০-৫০০ টাকা।
- রজনীগন্ধা ফুল গাছ: রজনীগন্ধা একটি শৌখিন ফুল যা সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত। এটি ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে ফুল দেয়। এর ফুল বাণিজ্যিকভাবে বিয়ে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- হরসিংগার ফুল গাছ: হরসিংগার গাছ সাধারণত তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ফুল ফোটায়। এই ফুল ঔষধি গুণাবলীর জন্য পরিচিত এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- চাঁপা ফুল গাছ: চাঁপা গাছ দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পূর্ণ আকারে পৌঁছায়। এটি দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং বছরব্যাপী ফুল ফোটায়।
কোন ফল গাছ তাড়াতাড়ি বড় হয়
বাংলাদেশের জলবায়ু এবং মাটির গুণমান বিবেচনায় কিছু ফল গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে ফল দিতে শুরু করে এবং কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- পেঁপে গাছ: পেঁপে গাছ মাত্র ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ফল দেয়। এটি বাড়ির বাগানে সহজেই চাষ করা যায়। পেঁপে ফল পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। এক কেজি পেঁপের দাম প্রায় ৪০-৬০ টাকা।
- কলা গাছ: কলা গাছ বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং দ্রুতবর্ধনশীল। এটি ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ফল দেয়। কলার বাণিজ্যিক চাষ কৃষকদের জন্য খুবই লাভজনক। এক থোকা কলার দাম প্রায় ১০০-২০০ টাকা।
- লেবু গাছ: লেবু গাছ এক বছরের মধ্যেই ফল দিতে শুরু করে। এটি বিভিন্ন ধরনের মাটিতে জন্মে এবং সারা বছর ফলন দেয়। এক কেজি লেবুর দাম ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
- আম গাছ (গুটি আম): গুটি আমের জাত দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল দেয়। এর ফলন এবং স্বাদ এটিকে স্থানীয় বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছে।
- পেয়ারা গাছ: পেয়ারা গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে ফল দেয়। পেয়ারা পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং এটি সারা বছর বাজারে পাওয়া যায়।
আর পড়ুন: কালোজিরা গাছ চাষ পদ্ধতি
দ্রুতবর্ধনশীল গাছ চাষাবাদের উপায়
গাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- মাটি নির্বাচন: দ্রুতবর্ধনশীল গাছের জন্য দোআঁশ এবং বেলে মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পুষ্টিগুণ ধরে রাখতে জৈব সার প্রয়োগ করা জরুরি।
- সঠিক পানি সরবরাহ: গাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে নিয়মিত সেচ প্রয়োজন। তবে অতিরিক্ত পানি দিলে গাছের শিকড় পচে যেতে পারে।
- সার ব্যবস্থাপনা: অর্গানিক এবং কেমিক্যাল সার গাছের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক। যেমন ইউরিয়া এবং পটাশ গাছের পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করে।
- আলো এবং ছায়ার ভারসাম্য: গাছের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যালোক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে কিছু গাছ ছায়ায়ও ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়।
- রোগ এবং পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ: দ্রুতবর্ধনশীল গাছের জন্য সঠিক রোগ এবং পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কীটনাশক এবং প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
দ্রুতবর্ধনশীল গাছ চাষে অর্থনৈতিক সুবিধা
দ্রুতবর্ধনশীল গাছের চাষাবাদ বাংলাদেশে কৃষকদের জন্য লাভজনক। এগুলো স্বল্প সময়ে ফলন দেয় এবং কম খরচে ভালো মুনাফা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে।
- কাঠের গাছের অর্থনৈতিক সুবিধা: ইউক্যালিপটাস এবং আকাশমণি গাছ কাঠের জন্য চাষ করা হয়। প্রতি ঘনফুট কাঠের দাম ৫০০-৮০০ টাকার মধ্যে যা কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসা।
- ফল গাছের চাষাবাদ: পেঁপে, কলা এবং লেবু গাছের চাষ খুবই লাভজনক। কম খরচে অধিক ফলন কৃষকদের আয়ের উৎস বৃদ্ধি করে।
- ফুলের চাষ: গাঁদা এবং রজনীগন্ধার মতো ফুলগাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হলে উৎসব এবং অনুষ্ঠানে ভালো লাভ প্রদান করে।
উপসংহার
দ্রুতবর্ধনশীল গাছ পরিবেশ সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এমন গাছের চাষাবাদ কৃষি এবং বনায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে এগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দিতে সক্ষম। তাই ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রে দ্রুতবর্ধনশীল গাছের চাষে এগিয়ে আসা উচিত। আপনার বাগানের জন্য দ্রুতবর্ধনশীল গাছ নির্বাচন করুন এবং পরিবেশ ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখুন।