বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে চোখে পড়া এক সাধারণ অথচ অতুলনীয় ঔষধিগুণসম্পন্ন উদ্ভিদ হলো আকন্দ গাছ। এই গাছকে সাধারণভাবে অবহেলা করা হলেও, প্রকৃতি আমাদের জন্য যে স্বাস্থ্যকর সম্পদ গড়ে তুলেছে, আকন্দ তার অন্যতম উদাহরণ। আকন্দ গাছ শুধু ঔষধি গাছ নয়, এটি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আকন্দ গাছ (Calotropis gigantea) একটি দুধজাতীয় কৌশলপূর্ণ উদ্ভিদ। এটি অ্যাসক্লেপিয়াডাসি (Asclepiadaceae) পরিবারভুক্ত। বাংলাদেশে এটি আকন্দ নামে পরিচিত হলেও, ভারত ও অন্যান্য অঞ্চলে একে “মাদার”, “আরকা”, বা “সুবর্ণপত্র” নামেও ডাকা হয়।
এটি সাধারণত ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ঝোপ আকৃতির গাছ হয়। গাছটি দেখতে ধুসর সবুজ রঙের এবং কাণ্ড ও পাতায় সাদা দুধের মতো তরল পদার্থ বের হয়। এই দুধে থাকে কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইডস ও অ্যালকালয়েড জাতীয় রাসায়নিক উপাদান যা ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়।
আকন্দ গাছ মূলত পতিত জমি, রাস্তার ধারে, নদীর পাড়ে ও খোলা স্থানে জন্মায়। এটি খুব কম পরিচর্যায়ও টিকে থাকে এবং অনেক সময় নিজের থেকে গজিয়ে ওঠে।
আকন্দ গাছের ব্যবহার বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতিতে এই গাছের বিভিন্ন অংশ বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহার হচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রামীণ সমাজে আকন্দ পাতার রস জ্বর, বাত ও ত্বকের রোগে ব্যবহারের প্রচলন ছিল।
লোকজ ঔষধে আকন্দ গাছের পাতায় তেল গরম করে পেটব্যথা ও ফোলা অংশে ব্যবহার করা হতো। আবার শিশুদের হজমের সমস্যা সমাধানে আকন্দের ফুল সিদ্ধ করে দেওয়া হতো। হিন্দু ধর্মে আকন্দ গাছকে পূজনীয় মনে করা হয় এবং অনেক সময় শিব পূজায় আকন্দ ফুল অর্পণ করা হয়।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আকন্দ গাছের শুকনো ডাল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও লোকগানে ও প্রবাদে এই গাছের নাম নানা অর্থবোধকভাবে এসেছে।
আকন্দ গাছের বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস
আকন্দ গাছকে বৈজ্ঞানিকভাবে নিম্নরূপ শ্রেণিবিন্যাস করা হয়:
রাজ্য: Plantae (উদ্ভিদ)
বিভাগ: Angiosperms (বীজযুক্ত উদ্ভিদ)
শ্রেণি: Eudicots
পরিবার: Apocynaceae
উপপরিবার: Asclepiadoideae
গণ: Calotropis
প্রজাতি: C. gigantea
এই গাছটি ট্রপিক্যাল ও সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এর খ্যাতি ও ব্যবহার বেশি।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, আকন্দ গাছের দুধের মধ্যে এমন কিছু বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান থাকে যা অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টিফাঙ্গাল হিসেবে কাজ করে। তাই এটি শুধু লোকজ নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত মূল্যবান।
আকন্দ গাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য
আকন্দ গাছের কয়েকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একে অন্যান্য সাধারণ উদ্ভিদের চেয়ে আলাদা করে:
বাহ্যিক গঠন
গাছটি গুল্ম জাতীয় এবং সাধারণত ৩–৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
কাণ্ড মোটা ও ধূসর-সবুজ রঙের।
ভাঙলে সাদা দুধ বের হয় যা দেহে লাগলে অস্বস্তিকর হতে পারে।
পাতা
পাতা মোটা, চামড়ার মতো এবং বিপরীতভাবে অবস্থান করে।
রঙ সবুজ ও স্পর্শে রাবারের মতো অনুভূত হয়।
পাতার শিরা স্পষ্ট এবং এটি সহজে ভাঙে না।
ফুল
আকন্দ গাছের ফুল বেগুনি অথবা সাদা রঙের হয়।
প্রতিটি ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে এবং তা মোমের মতো দেখায়।
গন্ধ হালকা হলেও টিকে থাকে দীর্ঘ সময়।
ফল ও বীজ
ফল ডিম্বাকৃতির এবং দুই ভাগে বিভক্ত।
বীজে তুলার মতো আঁশ থাকে যা বাতাসে সহজে ভেসে যায়।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো আকন্দ গাছকে অনন্য করে তুলেছে এবং এর ঔষধি ব্যবহারেও তা সহায়ক ভূমিকা রাখে।
আকন্দ গাছ কোথায় পাওয়া যায়?
বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই আকন্দ গাছের দেখা মেলে। তবে বিশেষ করে নিম্নোক্ত স্থানে বেশি জন্মে:
রেললাইন ও সড়কের পাশে
নদীর পাড়ে ও খোলা জমিতে
অনাবাদি ও শুকনো ভূমিতে
বাড়ির পাশে বা পুরাতন বসতির ধারে
আকন্দ গাছ সাধারণত বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মায় এবং এতে খুব একটা সেচ বা পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। এর বিস্তার এতটাই সহজ যে একবার বীজ পড়লেই বছর বছর গজিয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এই গাছ বিস্তৃতভাবে জন্মায়। এসব অঞ্চলের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এই গাছের ব্যবহার ব্যাপক।
আকন্দ গাছের প্রজাতি
আকন্দ গাছের মূলত দুটি প্রধান প্রজাতি দেখা যায়:
সাদা আকন্দ (Calotropis gigantea)
ফুল সাদা বা হালকা বেগুনি রঙের হয়
এটির ঔষধিগুণ বেশি বিবেচিত
তুলা বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়
বেগুনি আকন্দ (Calotropis procera)
গাঢ় বেগুনি ফুল
পাতাগুলো অপেক্ষাকৃত মোটা ও বড়
বেশি শুষ্ক এলাকায় জন্মায়
এই দুই প্রজাতির গাছের ফুল দেখতে আলাদা হলেও ঔষধি গুণাবলিতে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে সাদা আকন্দ তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহৃত হয় আয়ুর্বেদিক ও লোকচিকিৎসায়।
আকন্দ গাছের ঔষধিগুণ ও ব্যবহার
আকন্দ গাছ তার ঔষধি গুণের জন্য বিশেষ পরিচিত। এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান যা শরীরের নানা রোগ সারাতে সাহায্য করে।
পাতার রস: আথ্রাইটিস, হাঁপানি, ফুসফুসের রোগ ও বাতের ব্যথা কমাতে এটি ব্যবহার করা হয়। পাতার রস ঠাণ্ডা ও জ্বর কমাতে উপকারী।
গাছের দুধ (ল্যাটেক্স): এটি ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস থেকে সুরক্ষা দেয়, কাটা-ছেঁড়া জখমে সয়ঙ্ক্রমণ রোধ করে। দুধজাত তরলটি কিটনাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
ফুল ও ডাল: ফুল থেকে নির্গত পদার্থ ঘাড় ও পেটের ব্যথায় উপকারী বলে ধারণা রয়েছে। ডাল থেকে তৈরী আঠা হাঁপানি ও অস্থিসন্ধি ব্যথায় ব্যবহার হয়।
আয়ুর্বেদে আকন্দ গাছের গুঁড়া ও রস দিয়ে তৈরী ঔষধ বিভিন্ন জ্বর, ক্ষুধামন্দা, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা ও সর্দি-কাশি নিরাময়ে কার্যকর। ত্বকের ক্ষত, ফোস্কা বা ব্যথা কমাতে আকন্দ পাতার পেস্ট প্রয়োগের প্রচলন আছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ চিকিৎসক ও বুড়া-ছোটেরা ঘরোয়া ওষুধ হিসেবে আকন্দ গাছের নানা অংশ ব্যবহার করেন। তবে অত্যধিক ব্যবহার ক্ষতিকর হতে পারে বলে সতর্ক থাকতে হয়।
আকন্দ গাছের অন্যান্য ব্যবহার
আকন্দ গাছ কেবল ঔষধি নয়, এর অনেক ধরনের ব্যবহার রয়েছে:
কীটনাশক: গাছের দুধ ও পাতা কীটপতঙ্গ দমন করে। ফলে কৃষকরা পরিবেশ বান্ধব কীটনাশক হিসেবে এটি ব্যবহার করেন।
জ্বালানি: শুকনো ডাল ও কাণ্ড সুলভ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয় গ্রামীণ এলাকায়।
পশুখাদ্য: কিছু অঞ্চলে আকন্দ গাছের তরুণ পাতা পশুদের খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। তবে দুধযুক্ত অংশ সরাসরি না খাওয়ানোই ভালো।
সাজসজ্জা: আকন্দ গাছের ফুল ও পাতার অনন্য রূপ দিয়ে সৌন্দর্য বর্ধনেও ব্যবহার হয়।
এই গাছ অনেক সময় ফসলের ক্ষতি রোধে বা জমি সংরক্ষণের জন্য লাগানো হয়। ফলে কৃষি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় এর গুরুত্ব বেড়েছে।
আকন্দ গাছের চাষাবাদ ও রোপণ পদ্ধতি
আকন্দ গাছের চাষ তুলনামূলক সহজ। এর জন্য বিশেষ কোন উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন হয় না।
রোপণ মাধ্যম: বীজ বা কাটা ডাল থেকে গাছ জন্মানো যায়। বীজ সাধারণত শীতের শুরুতে বপন করা হয়।
মাটি: বেলে-দোআঁশ ও দোঁআশযুক্ত মাটিতে ভালো জন্মায়। অতিরিক্ত সেচ পছন্দ করে না।
আলো: সরাসরি রোদ প্রয়োজন। ছায়ায় গাছ দুর্বল হয়।
সেচ ও পরিচর্যা: সাধারণত বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল হলেও গ্রীষ্মে মাঝারি সেচ দরকার হয়।
কাটাছাঁট: নিয়মিত কাটা দিলে গাছের শাখা মোটা ও পাতা ঘন হয়।
রোগ ও পোকা প্রতিরোধ: আকন্দ গাছের প্রাকৃতিক সুরক্ষা থাকায় বেশি রোগ হয় না। তবে ল্যাটেক্সের কারণে পোকা কম আক্রমণ করে।
এই গাছটি জমি সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক। বাংলাদেশে এর চাষ বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে।